মাহিদুল ইসলাম: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা অন্যান্য কর্মচারীদের তুলনায় অনেক বেশি হারে বেতন নিচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোম্পানির এমডির বেতন অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও সেই তুলনায় কোম্পানির প্রফিট বাড়েনি দেয়নি ডিভিডেন্ট।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিজিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) প্রতিমাসে যে পরিমাণ আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং কোম্পানিগুলোর মুনাফা বৃদ্ধি, ডিভিডেন্ট ঘোষণা জামানত গ্রহন ও ঋণ প্রধান এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে সাফল্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এই রিপোর্টে।
১ম পর্ব প্রকাশের পর, দ্বিতীয় পর্যায়ে আজ তুলে ধরা হলো মাইডাস ফাইন্যান্সিং পিএলসির ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত।
২০১৯ সালে কোম্পানিটির এমডি মি. মুস্তাফিজুর রহমান বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ৮৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। একই সময় কোম্পানিটির নিট প্রফিট হয়েছিল ৯ কোটি ৬৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা এবং শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল .৭১ টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল ১১.৩৬ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ২.৫০ শতাংশ নগদ ও ২.৫০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছে। বছরে ৯ কোটি টাকা প্রফিট করে বিনিয়োগকারীদের ২.৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে এমডি নিজেই নিয়েছেন ৮৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা যা প্রতি মাসে ৭ লক্ষ টাকার অধিক।
২০২০ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা অবস্থায় মি. মুস্তাফিজুর রহমান বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ৯৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা। একই সময়ে কোম্পানিটির নিট প্রফিট হয়েছিল ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল .৮১ টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য হয়েছিল ১১.৬৫ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ২.৫০ শতাংশ নগদ ও ২.৫০ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছে । বছরে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রফিট করে বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে এমডি নিজেই নিয়েছেন ৯৪ লাখ ৭২ হাজার টাকার সুবিধা যা মাসিক ৭ লক্ষ টাকার অধিক।
এছাড়া ২০২১ সালেও কোম্পানিটির এমডি মি. মুস্তাফিজুর রহমান বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ৯৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা। একই সময়ে কোম্পানিটির নিট প্রফিট হয়েছিল ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল .৫৭ টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল ১১.৬৯ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১ শতাংশ নগদ ও ১ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছিল। বছরে ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা প্রফিট করেও বিনিয়োগকারীদের জন্য ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে এমডি নিজেই নিয়েছেন ৯৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা যা প্রতি মাসে ৭ লক্ষ টাকার অধিক।
২০২২ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মি. মুস্তাফিজুর রহমান বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ১ কোটি ৮৩ হাজার টাকা। একই সময়ে কোম্পানিটির নিট প্রফিট হয়েছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছিল .০৮ টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল ১১.৫৬ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য ১.৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বছরে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা প্রফিট করে বিনিয়োগকারীদের ১.৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়ে এমডি নিজেই নিয়েছেন ১ কোটি ৮৩ হাজার টাকা যা মাসিক হিসেবে ৮ লক্ষ টাকার অধিক।
২০২৩ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মি. মুস্তাফিজুর রহমান বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ৯৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা। একই সময়ে কোম্পানিটির নিট ক্ষতি হয়েছিল (৬৭) কোটি (৫৮) লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি লোকশান হয়েছিল (৪.৭০) টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল ৬.৭১ টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো শতাংশ দেয়নি। বছরে ৬৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ক্ষতি করে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ না দিয়ে এমডি নিজেই নিয়েছেন ৯৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা যা মাসিক হিসেবে ৮ লক্ষ টাকার অধিক।
২০১৯ সালে কোম্পানির লোন্স অ্যান্ড এডভান্স ছিল ৯৫১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা যা ২০২৩ সালে হয়েছিল ৯৫৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে ২০১৯-২০২৩ পর্যন্ত কোম্পানিটির লোন্স অ্যান্ড এডভান্স বেড়েছে ৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।
পক্ষান্তরে, ২০১৯ সালে কোম্পানিটির ডিপোসিট ও অন্যান্য প্রাপ্তি ছিল ৬২৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা যা ২০২৩ সালে হয়েছিল ৫৩৪ কোটি ৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে ২০১৯-২০২৩ পর্যন্ত কোম্পানিটির ডিপোসিট ও অন্যান্য প্রাপ্তি কমেছে ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
এছাড়া, ২০১৯ সালে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় ছিল ৮ কোটি ২৩ লাখ যা ২০২৩ সালে ক্ষতি হয়েছিল (৬১) কোটি (৫৮) লাখ। অর্থাৎ বিগত ৫ বছরে ২০১৯-২০২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয় কমেছে ৬৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের সমাপ্ত বছরে সমন্বিতভাবে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে -৪.৬৬ টাকা যা ২০২২ সালে ছিল .০৬ টাকা, ২০২১ সালে ছিল .৫৯ টাকা, ২০২০ সালে ছিল .৮৩ টাকা ও ২০১৯ সালে ছিল .৬৮ টাকা।
কোম্পানির গত ৫ বছরের সমন্বিত শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ (এনএভি) হয়েছে ২০২৩ সালে ৬.৭৯ টাকা যা ২০২২ সালে ছিল ১১.৬০ টাকা, ২০২১ সালে ছিল ১১.৭৬ টাকা, ২০২০ সালে ছিল ১১.৬৯ টাকা ও ২০১৯ সালে ছিল ১১.৩৮ টাকা।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কোম্পানিটি ২০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ২০০২ সালে তালিকাভূক্ত হয়েছে। কোম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ১৪৩ কোটি ৮৯ লাখ ৩০ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার ১৪ কোটি ৩৮ লাখ ৯২ হাজার ৫০৭ এবং রিসার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাস রয়েছে (৪৬) কোটি (২৬) লাখ টাকা।
ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ি ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ তারিখে উদ্যোক্তা পরিচালকের হাতে রয়েছে ৩৮.৫৯ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর হাতে রয়েছে ২৬.৩৩ শতাংশ শেয়ার, বিদেশি বিনিয়োগকারীর হাতে রয়েছে .৪২ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে রয়েছে ৩৪.৬৬ শতাংশ শেয়ার।
তথ্য অনুসারে, গত বছর কোম্পানিটির শেয়ার দর উঠানামা হয়েছে ৬.৮০ টাকা থেকে ১৩.৩০ টাকার মধ্যে। গতকাল সমাপনি দর ছিল ৮.৩০ টাকা এবং আজকের ওপেনিং দর ৮.৩০ টাকা। ২০০২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে কোম্পানিটি বর্তমানে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।
২০১৯ সালে কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন মোহাম্মদ নাছির-উদ্দিন চৌধুরি । তিনি (মোহাম্মদ নাছির-উদ্দিন চৌধুরি) লংকাবাংলা সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি বিডি ভেঞ্চার লিমিটেডের একজন পরিচালক।
২০২০-২০২১ পর্যন্ত ২ অর্থ বছরে কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে পুনরায় নিযুক্ত হন মিসেস রোকিয়া আফজাল চৌধুরি। ২০২২ সালে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইত্যাদি পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ থেকে একজন প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেও যোগদান করেন। তিনি সোনালী ব্যাংক লিমিটেড এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ২০২৩ সালে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল করিম ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭ তারিখে মাইডাস ফাইন্যান্সিং পিএলসির বোর্ডে যোগদান করেন এবং ১৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। ৩১ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারে দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেস (মাইডাস) এ যোগদান করেন এবং ১১ ডিসেম্বর, ২০১১ পর্যন্ত মাইডাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মে, ১৯৯৫ থেকে এপ্রিল, ২০০৪ পর্যন্ত মাইডাস ফাইন্যান্সিং পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়া ২০১৯-২০২৩ কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মি. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগ ব্যাংকিং পেশাদার, যার বাংলাদেশের কিছু শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (যেমন, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড) ৩০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। মি. রহমান ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মিডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেডে যোগদানের আগে তিনি প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং সিভিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এত দক্ষ ও অভিজ্ঞ চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকা সত্ত্বেও বিগত ৯ বছরে কোম্পানির সকল প্যারামিটার নিম্নমুখি কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আর্থিক সুযোগ সুবিধার প্যারামিটার সব সময় উর্ধ্বমুখি দৃশ্যমান। সুতরাং এর দায়ভার কার ব্যবস্থপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান নাকি পরিচালনা পর্ষদের?