কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক : অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার রাতে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন।
বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল রাত ১০টায় কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি ঢাকা ছেড়ে যাবেন।
যুক্তরাজ্যে পৌঁছার পর সরাসরি তাঁকে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নেওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে তাঁর চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র ও বিভিন্ন পরীক্ষার রিপোর্টসমূহ সেখানে পাঠানো হয়েছে।
লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যাসহ নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগতে থাকা ৭৯ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার রাতে প্রথমে লন্ডনে তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে যাবেন।
জনস হপকিন্স হাসপাতালের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় এসে এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়ার লিভার ও পেটের ফ্লুইড জমা ও রক্তক্ষরণ রোধে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশেষ পদ্ধতি টিআইপিস-টিপস সম্পন্ন করেছিলেন। পরে খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই হাসপাতালেই লিভার প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেয়। তাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম বিএনপি চেয়ারপারসনের লিভার প্রতিস্থাপন চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
এদিকে, এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি খালেদা জিয়াকে লন্ডন ক্লিনিকে নেওয়া হবে। সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী খালেদা জিয়ার পরবর্তী চিকিৎসা চলবে। এসব কথা জানিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন।
সোমবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে গুলশান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মলনে এসব কথা জানান তিনি।
ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, আজকে সন্ধ্যায় সাড়ে ৭টায় খালেদা জিয়াকে বহন করার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসবে।
তিনি বলেন, লন্ডন বিমান বন্দরে খালেদা জিয়াকে রিসিভ করবেন তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও স্ত্রী ড. জোবায়দা রহমান এবং লন্ডন বিএনপির দুই নেতা। আর ঢাকা থেকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে চিকিৎসকদের পাশাপাশি তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান যাবেন।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়ার লন্ডন যাত্রার সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর রোববার রাত ৯টায় গুলশানে তার বাসা ‘ফিরোজা’য় স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ৩০ মিনিট নেতাদের সঙ্গে হাসি-খুশি কথাবার্তা বলেন। এ সময় দেশ ও গণতন্ত্রের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে নেতাদের নির্দেশ দেন বিএনপি প্রধান।
‘ফিরোজা’ থেকে বেরিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের কাছে লন্ডন যাত্রার দিনক্ষণ আনুষ্ঠানিভাবে জানিয়ে বলেন, ‘আল্লাহতালার অশেষ রহমতে আমাদের নেত্রী তার চিকিৎসার জন্যে আগামী ৭ জানুয়ারি রাতে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবেন। সেই কারণে আমরা জাতীয় স্থায়ী কমিটির সকল সদস্য উনার কাছে এসেছিলাম শুভেচ্ছা জানাতে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা তাঁর (খালেদা জিয়ার) সঙ্গে আলাপ করেছি, কথা বলেছি। পরম করুণাময় আল্লাহ’তালার কাছে এই দোয়া করেছি, আল্লাহ তাকে সুস্থ করে আবার আমাদের মাঝে, দেশের মানুষের মাঝে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং গণতন্ত্রের জন্য আমাদের চলমান সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তা সফল করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষেরও সেই প্রত্যাশা।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা দোয়া করছি তাঁর (খালেদা জিয়ার) যাত্রা যেন সফল হয় এবং তিনি সুচিকিৎসা নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারেন।’
কবে নাগাদ বেগম জিয়া ফিরবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো চিকিৎসকরা বলতে পারেন। আমরা আশা করি উনি চিকিৎসা শেষে খুব শিগগিই দেশে ফিরে আসবেন।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হেসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও এজেডএম জাহিদ হোসেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করেন।
৭৯ বছর বয়সী প্রবীণ এই রাজনীতিকের এবারের বিদেশযাত্রা উন্নত চিকিৎসার জন্য হলেও গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন-পরবর্তী এ যাত্রা নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও কৌতূহল রয়েছে।
সাত বছর পর লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেখা হবে। ছেলের বউ জোবাইদা রহমান ও নাতনি জাইমা রহমানও খালেদা জিয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এমন পরিস্থিতিতে দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে তাঁর বিদেশে চিকিসার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান, চিকিৎসক, বিএনপি নেতারা, ব্যক্তিগত কর্মী ও দুজন গৃহকর্মী থাকবেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, মা-ছেলের দীর্ঘ কাঙ্ক্ষিত এই সাক্ষাতে দেশ, দল ছাড়াও ভবিষ্যতের রাজনীতি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হতে পারে। সবার প্রত্যাশা, চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে দ্রুত দেশে ফিরবেন।
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। ২০১৮ সালে একটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর তাঁর অসুস্থতা বাড়ে। এর মধ্যে কয়েকবার তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও পড়েন। একাধিকবার তাঁর মৃত্যুর গুজবও ছড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে তাঁর বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। বরং তাঁর রোগ ও চিকিৎসা নিয়ে সরকারের শীর্ষ পদ থেকে বিভিন্ন সময় নানা আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে।ফলে অসুস্থ্য নেত্রীর বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে রাজপথে টানা আন্দোলন করেছে বিএনপি।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির এক আদেশে খালেদা জিয়া মুক্তি পান। এরপর দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দী হয়েছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল করেন আদালত।
মুক্তি পাওয়ার পরে গত ৭ আগস্ট রাজধানীতে প্রথম সমাবেশে যোগ দেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়; ওই হাসপাতাল থেকেই পল্টনের সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন বিএনপি নেত্রী।
বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনর্নির্মাণ করতে হবে। তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও শোষণহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হবে। আসুন প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা দিয়ে নতুন সমাজ গড়ে তুলি।
গত ২১ নভেম্বর এক যুগ পর ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে যান খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের পর এই প্রথম তিনি প্রকাশ্য কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেন।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার লিভার প্রতিস্থাপন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লিভার প্রতিস্থাপনের পর পুরো চিকিৎসায় কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসা শেষ হলে বিএনপির চেয়ারপারসন আবার লন্ডনে যাবেন। সেখান থেকে সৌদি আরবে পবিত্র ওমরাহ পালন করে তারপর দেশে ফিরতে পারেন।
খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রা ও এর দিন-তারিখ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা চলছিল। একাধিকবার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। খালেদা জিয়াসহ সফরসঙ্গীদের কারও কারও ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতাও ছিল। শেষে ৭ জানুয়ারি চূড়ান্ত হয় এবং সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সৌদি আরবের ভিসা নিয়েছেন।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে তৎকালীন সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান তিনি।