আহসান আলম, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: ‘দিন শেষ মানেই অন্ধকার নয়, নতুন দিনের শুরু’ ‘হতাশা মানেই শেষ নয়, নতুন উদ্যোমে এগিয়ে চলা’-কথাটির বাস্তবে রূপ দিয়েছেন একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হেলেনা খাতুন। ব্লক-বাটিক, হ্যান্ড পেইন্ট, কুশি কাটার, পিঠা-পুলি অনলাইন ও অফলাইনের মাধ্যমে ব্যবসা করে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়ীতা সম্মাননা ও বিভিন্ন ক্যাটাগড়িতে পুরস্কার। চুয়াডাঙ্গা শহরের ঈদগাহ পাড়ার বাসিন্দা মো. হাসানের স্ত্রী হেলেনা খাতুন।
চুয়াডাঙ্গা জেলার শিল্পনগর খ্যাত দর্শনার আজিমপুর গ্রামের মৃত হেলাল উদ্দীনের তিন সন্তানের মধ্যে হেলেনা খাতুন সবার বড়। শিশুকাল গ্রামের বাড়িতে কাটলেও বাবার ব্যবসার সুত্র ধরে সেই থেকে চুয়াডাঙ্গা শহরের দক্ষিণ গোরস্থান পাড়ায় বসবাস শুরু করেন। পড়াশোানয় বেশ ভালো ছিলেন। কৃতিত্বের সঙ্গে ভালো রেজাল্ট নিয়ে স্কুল, কলেজ পর্ব শেষ করেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এস.এস.সি পাশ করার পর ভর্তি হয় চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে। সেখান থেকে ২০০৩ সালে এইচ.এস.সি অধ্যায়নকালে বিয়ের পিড়িতে বসেন হেলেনা খাতুন। ওই বছরই এইচ.এস.সি পাশ এবং একই বছর গ্রহণ করেন মাতৃত্ত্বের স্বাদ। তারপর ডিগ্রী ভর্তি হওয়া। সন্তান মানুষ করতে হবে এই ভেবে পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছা থাকার পরও ২য় বর্ষের পরীক্ষার পর আর পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। সংসার জীবনে দুই কন্যা সন্তানের জননী তিনি। বড় মেয়ে রামিসা আনান প্রমি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ এ বিবিএ প্রথম বর্ষে এবং ছোট মেয়ে আনিসা আনান প্রতিভা চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেনীতে অধ্যয়নরত। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা শেষে করে শিক্ষাকতা করার। পারিপর্শ্বিক কারনে তা আর হয়ে ওঠেনি।
২০১১ সালের দিকে ছোট মেয়ে প্রতিভার বয়স যখন ৩ বছর তখন স্বামীর চাকুরীর সুবাদে কক্সবাজারে বসবাস শুরু করেন। এর মাঝেই ২০১৩ সালে স্বামীর প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে অর্থনৈতিকভাবে দুশ্চিন্তায় পড়েন হেলেনা খাতুন ও তার পরিবার। সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখন থেকে চিন্তা করতেন যদি কিছু একটা করা যেত। সেই ভাবনা থেকেই শুরু এবং উদ্যোক্তা হয়ে উঠা।
কর্পোরেট সংবাদের এ প্রতিকেদকের সাথে আকান্ত আলাপচারীতায় হেলেনা খাতুন বলেন, হতাশাগ্রস্থ হয়ে ভাবতে থাকি কিছু একটা করতে হবে। ঠিক সেই সময় আমার প্রতিবেশি এসে বলেন, বসে থেকে কি করবেন? আমি যেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি আপনিও সেখানে কিছু প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। মনের মধ্যে আশার আলো জেগে ওঠে। ক’দিন পর কক্সবাজার জেলা পরিষদ ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে হাতের কাজ ও সেলাই মেশিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং জে.টি.সি নামক এক এনজিও সংস্থা থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
হেলেনা খাতুন আরও বলেন, কক্সবাজারে দুইটি বছর পার করে ২০১৫ সালের দিকে সবাই মিলে চুয়াডাঙ্গায় চলে আসি। তখন আমাদের পরিস্থিতি দেখে আমার আব্বু-আম্মু আমার পাশে এসে দাড়ায়। আব্বু আমাকে বলেন বাইরে থেকে পণ্য কিনে এনে কেন বিক্রি করবা! নিজে নিজে উৎপাদন কর। ঠিক তখনই ভাবতে শুরু করি “কিভাবে শুরু করবো, কিভাবে তৈরি করবো, কিভাবে বিক্রি করবো” নতুন জায়গায় কে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, খুব ভয় লাগছিলো। তখন সাহস করে নিজ উদ্যোগে একজন মেয়েকে হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী তৈরি করি। সর্বপ্রথম একটি হাতের কাজের থ্রী-পিস তৈরী করে আমার ভাইয়ের মাধ্যমে ঢাকা নিউ মার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে থ্রী-পিসটি দেখাতে নিয়ে যায়। দোকানদার থ্রী-পিসটি দেখে অনেক পছন্দ করেন। দোকানদার প্রথমে আমাকে ৩০টি হাতের কাজের থ্রী-পিসের অর্ডার দেন। আমি এতো থ্রী-পিস কিভাবে অর্ডার নিব! আমার এতো পুঁজি এবং কর্মী কোনটায় নেই। আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই আর কিভাবে অর্ডার রেডি করব ভাবতে শুরু করি। যদি কর্মী তৈরি করতে পারি তাহলে অর্ডার নিতে পারব। এই উদ্দ্যেশ্যে সামান্য পুঁজি দিয়ে কর্মী তৈরি করা শুরু করি। এক এক সময় এক এক গ্রামে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে খেয়ে না খেয়ে খুব কষ্ট করে শুরু করি। অনেক কষ্টে ৩০টি থ্রি-পিস তৈরি করে দিই। সেখান থেকে বেশকিছু লাভ হয়।
এরপর বঞ্চিত মহিলাদের হাতের কাজ এবং সেলাইমেশিনে বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিতে থাকি। এভাবে সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের পাশে এসে দাড়ায় এবং তাদেরকে বোঝাতে থাকি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কিভাবে আয় করতে পারবে। তারপর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাবার অনুপ্রেরণা, মায়ের উৎসাহ আর স্বামীর সহযোগীতায় আজ আমি সফলতা অর্জন করতে পেরেছি। এখন পর্যন্ত আমি নিজ উদ্যোগে নিজ হাতে প্রায় ১০০০ সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, একজন কর্মী পারে একজন উদ্যোক্তাকে সৃষ্টি করতে। কর্মী থাকলে প্রতিষ্ঠান থাকবে, কর্মীরা বাঁচলে প্রতিষ্ঠান বাঁচবে। বর্তমানে প্রতিভা মহিলা ও শিশু উন্নয়ন সংস্থা নামে আমার প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে সকল প্রকার হাতের কাজের থ্রী-পিস, ওয়ান-পিস, টু-পিস, কুশন-কভার, নকশী কাঁথা, শাড়ী তৈরী করা হয় এই কর্মীদের দ্বারা। আমার এখানে প্রায় ৯০/৯৫ জন কর্মী নিয়মিত কাজ করছেন। একজন সফল উদ্যোক্তা হিসাবে অনেক দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারের আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পেরে আমি অনেক গর্বিত। এখন আমার মূল লক্ষ্য সামাজিক উন্নয়নমূলক সংস্থার মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জন্য আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এবং দারিদ্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে অবদান রাখা।
এদিকে, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা, নেতৃত্বদানকারী সফল নারীর পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষকের সম্মাননাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে পেয়েছেন সনদপত্র।