এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া : বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
আমাদের জাতি সত্ত্বার কবি, প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের এক অমর স্মৃষ্টি। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর, শেষ দিকে ক্রিসমাসের রাতেই কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের একটি বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করেছিলেন এই কালজয়ী কবিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ২২ বছেরের যু্বক রচনা করেছেন এই অমর কবিতা। এ কবিতাটি রচনার মাধ্যমে কবি নজরুল ইসলাম তৎকালীন কলকাতা যথা বাংলা-ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতা রচনার মাধ্যমে কবি নজরুল পরিচিত হয়েছিন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসাবে।
সাহিত্য বিষারদ আর বিশ্লেষকরা মনে করেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের সময়ে তার ধারার বাইরে এসে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা এই সৃষ্টি সাহিত্যে নতুন ধারার সুচনা করেছে।
বৃটিশ শাসকদের প্রায় দু’শ বছরের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নে জর্জরিত জাতিকে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর উৎসাহ যুগিয়ে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবিতাটি রচনার মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম পরাধিন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দিয়েছিলেন। সাথে নিজেও ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
বৃটিশ বিরোধী পরাধীনতার শৃংখল ভেঙ্গে ভারতের তরুণ সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে উৎসাহ যুগিয়েছিল বিদ্রোহী কবিতা। জীর্ণশীর্ণ ও দু’শ বছরের একটি পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন ও শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে বিদ্রোহী কবিতার ভূমিকা অত্যান্ত গূরুত্বপূর্ণ।
কবি নজরুল ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিললে পাকিস্থানের করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে এসেই সর্বপ্রথম পরিচিত হন কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে। পরিচয়ের পর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে তাদের মাঝে।
২০২১ সালেই কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি বিদ্রোহী কবিতার শত বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই শত বছরেও বিদ্রোহী কবিতার আবেদন ফুলিয়ে যায়নি। এই কবিতার আবেদন রয়ে গেছে আগের মতই। মনে হয় কবিতা সৃষ্টি হয়েছে সকল সময়ের জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে গনমানুষের মুক্তির কথা নিয়ে।
বিদ্রোহী কবিতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল মন্তব্য করেছেন, “ঔপনিবেশিক ভারতের সেই সময় যখন নজরুল আবির্ভূত হলেন, তখন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঔপনিবেশিক বিরোধিতা বড় করে তুলছেন। বল বীর, চির উন্নত মম শির, এই বীর তিনি বলছেন সমস্ত বাঙ্গালিকে, যে বীরের মতো তোমরা উঠে দাঁড়াও। ভীরু বাঙ্গালিকে উদ্দীপ্ত করে তুলতে চেয়েছেন, তাদের জাগ্রত করতে অসংখ্য শব্দের ঝংকারে কবিতাটি যেন পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে।”
ডিসেম্বরের সেই রাতে বিদ্রোহী কবিতা রচনার পরের দিন সকালে কবিতাটি প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন তার সঙ্গে থাকা বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদকে।
এ প্রসঙ্গে কমরেড মুজফফর আহমদ তাঁর “কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা” বইয়ে বলেছেন, ”বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়।
সেখানে কমরেড মুজফফর আহমদ আরো লিখেছেন, ”তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূর্ব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচের দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ”বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে।” ”পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল। ”বিদ্রোহী” কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।”
এ প্রসঙ্গে ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে মুজফফর আহমদ আরো লিখেছেন, ”আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাত্রে কবিতাটি লিখেছিল, তা না হলে এত সকালে সে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না। ….এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে নজরুলের কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। তাই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেন্সিলে লিখেছিল।”
সেইদিনই বেলা হওয়ার পর ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হক সেই বাড়িতে আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি সেটা শুনে একটি কপি সাথে করে নিয়ে যান।
কমরেড মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ”আমিও বাইরে চলে যাই। তারপরে বাড়িতে ফিরে আসি বারোটার কিছু আগে। আসা মাত্রই নজরুল আমায় জানাল যে, ‘অবিনাশদা (বারীন ঘোষেদের বোমার মামলার সহবন্দী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য) এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার স্থিরতা নেই, কপি করে দাও, বিজলীতে ছেপে দেই আগে। তাকেও নজরুল সেই পেন্সিলের লেখা হতেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিল।”
১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। বৃষ্টি হওয়ার পরেও কাগজের চাহিদা এতো হয়েছিল যে, সেই সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রকাশক।
কমরেড মুজফফর আহমদ এ প্রসঙ্গে তার বইয়ে আরো লিখেছেন, ”বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের কথাও শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন এবং নজরুলের মুখে শুনেই লিখেছেন। তাতে আছে, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন।”
বিদ্রোহী কবিতাকে ব্যাঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস ‘ব্যাঙ’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলো, যা শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্যারোডি করে লিখেছিলেন, ‘আমি ব্যাঙ/ লম্বা আমার ঠ্যাং/ আমি ব্যাঙ/ আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/ আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।”
নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ”বাংলা কবিতায় একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লেখা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মতো কেউ কেউ সেই বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুরোপুরি বাইরে যেতে পারেননি। প্রমথ চৌধুরী চলতি ভাষা চালু করলেন।”
”প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।”
বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।”
বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলার সমাজ জীবনে, রাজনৈতিক জীবনে, বিভিন্ন আন্দোলনে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করেছে। এই কবিতা সেই সময় নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, সেটা নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তবে, বৃটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও যেখানেই এসব পত্রিকা পেতো, সেগুলো জব্দ করতো। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল। বাংলা সাহিত্যে “বিদ্রোহী” কবিতা ছাড়া আর কোন কবিতা এত বেশী আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল বলে আমার জানা নাই। বিদ্রোহী কবিতা রচনার শত বছর পরেও সেই আবেদন এতটুকুও হ্রাস পায় নাই।
বিদ্রোহী কবিতাটিতে ১৪টি ছোট-বড় স্তবক, ১৪১টি লাইন বা পংক্তি এবং ১৪৫ বার ‘আমি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ‘আমি’ দ্বারা তিনি হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন-ভারত বর্ষের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি মানুষের প্রতিনিধি। তিনি কবিতার ভাষায় বলতে চেয়েছেন কারো অধীন হয়ে নয়-বরং আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাই মানুষের সার্থকতা। ভাব-ভাষা ও উপমা-ছন্দে বিদ্রোহী কবিতাটি কবির এক অনবদ্য রচনা।
বিদ্রোহী কবিতাটি যখন কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেন – তখন ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল এবং এক উত্তাল হাওয়া বিদ্যমান ছিল। গোটা ভারতবর্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। তার এই পরিস্থিতির মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘বিদ্রোহী’ স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের মনে সৃষ্টি করেছিল স্বাধীনতার ঢেউ।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার এ পুন: পুন: প্রকাশনা তখনকার সময়ে পাঠক ও প্রকাশকের মধ্যে এর তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ বহন করে। একই বছর এটি মাসিক ‘প্রবাসী’ এবং মাসিক ‘বসুমতী’ এবং পরের বছর ১৩২৯ বঙ্গাব্দে মাসিক ‘সাধনা’য় পুন:প্রকাশিত হয়।
কবি যে বাড়ীতে বসে এই কবিতাটি রচনা করেছেন সেটি ‘রাজেন্দ্র কুঠির’ নামে পরিচিত ছিল। পরে মালিকানা পরিবর্তন হয়ে সীমা সাহার বাড়ি’ হয়। বর্তমানে ‘নজরুল স্মৃতি কক্ষ’ হিসেবে পরিচিত সেই কক্ষটি।
১৯২৯ সালে ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বিদ্রোহী কবি বা জাতীয় কবি হিসেবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল। সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং সভাপতি ছিলেন ভারতের তৎকালীন বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সভায় মানপত্রটি দান করেন মি. এস. ওয়াজেদ আলি। প্রসঙ্গত: এটা স্বীকার করতেই হয় যে, বিদ্রোহী কবিতার জন্ম বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জল মাইল ফলক।
অভিনন্দনের উত্তরে কবি নিম্নলিখিত প্রতিভাষন দান করেন। নজরুলের অনন্য প্রতিভাষন সকলকে মুগ্ধ করে। নজরুল এখানে তাঁর সম্পর্কে ব্যবহৃত ‘বিদ্রোহী’ বিশেষণটি সম্পর্কে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেনঃ “আমাকে বিদ্রোহী বলে খামকা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ-কেউ। এ নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কেনদিনই নেই। তাড়া যারা খেয়েছে, অনেক আগে থেকেই মরণ তাদের তাড়া করে নিয়ে ফিরছে। আমি তাতে এক-আধটু সাহায্য করেছি মাত্র।”
কাজী নজরুল বলেছেন, “বিদ্রোহী-র জয়-তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালোবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্ক-তিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি। বেদনা-সুন্দরের গান গেয়েছি বলেই কি আমি সত্য-সুন্দরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি? আমি বিদ্রোহ করেছি — বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন-পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। হয়তো আমি সব কথা মোলায়েম করে বলতে পারিনি, তলোয়ার লুকিয়ে তার রূপার খাপের ঝকমকানিটাকে দেখাইনি-এই তো আমার অপরাধ। এরই জন্য তো আমি ‘বিদ্রোহী’। আমি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, সমাজের সকল কুসংস্কারের বিধি-নিষেধের বেড়া অকুতোভয়ে ডিঙিয়ে গেছি, এর দরকার ছিল মনে করেই।”
পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি থাকা, ব্রিটিশরাজের অনুগ্রহ ও করুনা প্রত্যাশী বাঙালি জাতিকে কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী বাঙালি তরুণ সমাজের কাছে বিদ্রোহী কবিতাটি ছিল রক্তে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী, হৃদয়ে অগ্নি-প্রজ্বলনকারী এক বজ্রকঠিন ধ্বনি।
বিদ্রোহী কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই পুরাণ প্রসঙ্গ ঢুকিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ সরকার সরাসরি একে রাজদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহি বলে চিহ্নিত করতে পারে নাই।
অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত তার জৈষ্ঠ্যের ঝড় রচনায় বলেছেন, “কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী কবিতায় কখনো ঈশান-বিষানের হুঙ্কার বাজছে, কখনো বা ইস্রাফিলের শিঙ্গা থেকে উঠছে ঝঙ্কার। কখনো বা হাতে নিয়েছে মহাদেবের ডমরু-ত্রিশূল, কখনো বা আর্ফিয়াসের বাঁশি। কখনো বাসুকীর ফণা জাপটে ধরেছে। কখনো বা জিব্রাইলের আগুনের পাখা, কখনো চড়েছে তাজি বোরাক কে কখনো বা উচ্চৈঃ শ্রবায়। একে রাজদ্রোহ বলতে গেলে ধর্মের উপরে হাত দেওয়া হবে।”
পরিমল গোস্বামী তার আমি যাঁদের দেখেছি রচনায় বলেছে, “অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এমন ভাষায় আর কোন বাঙালি কবি চ্যালেঞ্জ জানাননি। সমাজের উৎপীড়নে এমন শপথ আর কারো মুখে শুনিনি। Must fight to the finish মন্ত্রে দীক্ষিত আর কোন বাঙালি কবি শত্রুপক্ষকে এমন আহ্বান জানাননি।”
পরিমল গোস্বামী আরো বলেন, ” ‘বিদ্রোহী’ কবিতা কবির প্রথম আত্মোপলব্ধিজাত কবিতা। এ কবিতা তাঁর মনে প্রবেশের প্রথম দরজা। কবি কোন বাণী নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করলেন তার পরিচয় আছে এ কবিতায়। তাঁকে এখন আর কোন বন্ধনে বাঁধতে পারবেনা, সকল প্রথা ও অত্যাচারের ঊর্ধ্বে তিনি, যোদ্ধা তিনি, বিরাট শক্তিধর তিনি, আত্ম উপলোব্ধি-আত্মসম্মানবোধে মহীয়ান তিনি-তাই তিনি সদা উন্নত শির ঋজু দন্ডী। তাই তিনি বলতে পারেন ‘আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্নিশ।’ আজ যাঁকে বেশী প্রয়োজন ছিল।”
প্রেমেন্দ্র মিত্র তার নজরুল স্মৃতি রচনায় বলেন, ” পূর্বের কিছু কিছু রচনায় রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেই নজরুল ইসলাম সমস্ত সাহিত্য জগতের কাছে সচকিত স্বীকৃতি যেন সবলে আদায় করে নেন। –
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ” ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি একসঙ্গে ‘মোসলেম ভারত’ ও ‘বিজলী’-তে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলের খ্যাতিতে বাঙালি সমাজ একেবারে টগবগ করে উঠলো। তরুণ সমাজ তো বিদ্রোহীর ভাষায় বাক্যালাপ শুরু করে দিলো। সকলের মধ্যে সেই মনোভাব — ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিশ’। –
‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তর সাধকঃ সাহিত্যচর্চা’ বুদ্ধদেব বসু বলেন, ” কৈশোরকালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরোবার ইচ্ছেটাকেও অন্যায় মনে হত-যেন রাজদ্রোহের সামিল; আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রাভরা নেশা, তার বেলোয়ারি আওয়াজের জাদু-তাও আমি জেনেছি। আর এই নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার; আর অন্য কিছু চাইলোনা কেউ, অন্য কিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলনা-যতদিন না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হৈ-হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো।”
বিদ্রোহী’ দেখবামাত্র নজরুলের ভেতরে আমি হুইটম্যান আর রবীন্দ্রনাথ দুজনকেই একসঙ্গে পাকড়াও করেছিলাম। তবুও বুঝেছিলাম লেখক বাপকা-বেটা বটে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম কুরুক্ষেত্রের পরবর্তী অন্যতম যুগ-প্রবর্তক বাঙ্গালীর বাচ্চা নজরুল।’ (সাক্ষাতকার: বিনয় সরকার, ৬ জুন ১৯৪৩, বিনয় সরকারের বৈঠকে, প্রথম ভাগ, কলকাতা, ২০০৩, পৃ-৩৯৯)
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ হবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী রচনা ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন