বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে জিএসপি সুবিধার বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ জন্য গত সপ্তাহে ঢাকায় ঘুরে গেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের চার সদস্য। তাঁরা শ্রমিকদের সংগঠন ও দর-কষাকষি করার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) শ্রম আইন বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
প্রশ্ন: ইপিজেডে শ্রম আইন বাস্তবায়ন করতে চাপ বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বিজিএমইএর অবস্থান বা মতামত কী?
সিদ্দিকুর রহমান: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্যই ইপিজেডে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে ইপিজেডের বাইরের হাজার হাজার কারখানা যদি শ্রম আইনের আওতায় চলতে পারে, তাহলে ইপিজেডের ভেতরের কারখানাগুলো কেন পারবে না? আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পণ্য রপ্তানির সিংহভাগ ইপিজেডের বাইরের কারখানাগুলোর দখলে। সে জন্য ইপিজেডের কারখানাগুলোকে সুবিধা দিতে গিয়ে বাইরের কারখানাগুলোকে বিপদে ফেলা কতটা যুক্তিসংগত, সেটি ভেবে দেখা দরকার। ইপিজেডের কারখানাগুলোতে শ্রমিক কল্যাণ কমিটি করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। ৫১ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি নিয়ে আবেদন করতে হয়। সে জন্যই মূলত জোরালো আপত্তি আসছে। তবে আমরা মনে করি, বর্তমান শ্রম আইনেই ইপিজেড পরিচালিত হতে পারে। খুব দ্রুততার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে একটি সমাধানে পৌঁছাতে হবে।
প্রশ্ন: সরকার ও বিজিএমইএ প্রায়ই বলে, রানা প্লাজা ধসের পর গত চার বছরে শ্রমিক অধিকার বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ প্রতিনিয়ত শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে চাপ দিচ্ছে। সমস্যা কোথায়?
সিদ্দিকুর রহমান: উন্নতির কোনো শেষ নেই। রানা প্লাজা ধসের পর সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষ মিলে প্রচুর কাজ করেছে। তবে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের করতে হয়। যেহেতু ট্রেড ইউনিয়ন করতে আমাদের শ্রমিকেরা প্রশিক্ষিত কিংবা আগ্রহী নন, সে জন্য সর্বশেষ শ্রম আইনের সংশোধনীতে নির্বাচনের মাধ্যমে ওয়ার্কার পার্টিসিপেশন কমিটি গঠন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি হলে শ্রমিকদের নির্বাচন সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান বাড়বে। এভাবেই ভবিষ্যতে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত হবেন শ্রমিকেরা। আমরা মনে করি, শ্রম আইনের এই বিষয়টি বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
প্রশ্ন: আপনি বললেন, ট্রেড ইউনিয়ন করতে শ্রমিকেরা আগ্রহী নন। কিন্তু শ্রমিকনেতারা বারবারই অভিযোগ করছেন, শ্রম আইনের একাধিক ধারা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ট্রেড ইউনিয়ন করতে মালিকেরা বিভিন্নভাবে বাধা দিচ্ছেন।
সিদ্দিকুর রহমান: এটি ভুল ধারণা। একটি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন হয়ে গেলে সেই ইউনিয়নের নেতাদের ছাঁটাই তো দূরে, বদলি পর্যন্ত করা যায় না। মূল বিষয় হচ্ছে, ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদেরও প্রশিক্ষণ দরকার। কারণ সাধারণ শ্রমিকদের ওপর ইউনিয়নের নেতাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন সময় উসকানি দিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের তাঁরা কারখানার বাইরে আনতে পারলেও কখনোই তাঁরা শ্রমিকদের ভেতরে নিয়ে যেতে পারেন না।
প্রশ্ন: গত ডিসেম্বরে আশুলিয়ায় শ্রমিক আন্দোলন থামাতে ছাঁটাই, মামলা ও কারখানা বন্ধের মতো দমনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপরই শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে দেশি-বিদেশি চাপ আগের চেয়ে বেড়ে যায়। তাহলে কি শ্রমিক আন্দোলন থামাতে আশুলিয়ায় যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেটি ভুল ছিল?
সিদ্দিকুর রহমান: অবশ্যই ঠিক ছিল। কারণ আমাদের সাধারণ শ্রমিকেরা কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাজ করতে দেওয়া হয়নি। তাঁদের মারধর করা হয়েছে। হুমকি দেওয়া হয়েছে। এভাবে তো আপনি জোর করে কাজ বন্ধ করতে পারেন না। অবশ্যই একজন মালিকের অধিকার আছে সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাওয়া। অন্যদিকে কারখানা বন্ধ রাখার পর আবার খুলে দেওয়া হলো, তখন দেখা গেল প্রথম দিনই ৯৫ শতাংশ শ্রমিক হাজির। তার মানে, সেই আন্দোলনে শ্রমিকদের সমর্থন ছিল না। অনেক শ্রমিকনেতা আমাদের বলেছেন, আন্দোলনের ব্যাপারে তাঁরা কিছু জানেন না।
প্রশ্ন: আগামী জুনে আইএলওর সম্মেলন ও এর আগে সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্টের পর্যালোচনা সভায় শ্রম অধিকার বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি করতে হবে। না হলে ইইউ জিএসপি হুমকিতে পড়তে পারে। এ বিষয়ে আপনারা কী করছেন?
সিদ্দিকুর রহমান: আমরা মনে করি, কোনোভাবেই আমাদের এখানে শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে না। তবে চাহিদার যেমন শেষ নেই, উন্নতির কোনো শেষ নেই। গত বছর আইএলওর সম্মেলনে যে চারটি বিষয়ে উন্নতি করতে বলা হয়েছিল, আমরা অবশ্যই সেসব করব। আমরা যথেষ্ট কাজ করেছি। আইএলওর সঙ্গে কাজ হচ্ছে।
সৌজন্যে: প্রথম আলো