বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে জীবনযাত্রা। মানুষের জীবন-জীবিকা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণ জনগোষ্ঠীর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার কারণে মার্চ মাস থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত (চার মাসেরও বেশি সময়) প্রায় সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বন্ধ রয়েছে। ফলে এই সময়ের মধ্যে হাজার হাজার চাকরিপ্রত্যাশীর চাকরির আবেদনের বয়স (৩০ বছর) পার হয়ে গেছে। করোনাকালের একেকটি দিন যাচ্ছে আর কত-শত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীর চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে! একজন চাকরিপ্রত্যাশী বেকারের জীবনে চাকরির আবেদনের বয়স পার হওয়ার শেষ দিনগুলো যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেই ভুক্তভোগীই শুধু বলতে পারবে। এই ভয়াবহ দুর্যোগের পরিসমাপ্তি কবে ঘটবে, তাও নিশ্চিত করে বলা মুশকিল! করোনার কারণে আবার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় (সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে) সেশনজটের শঙ্কা বেশি! বর্তমান প্রেক্ষাপটে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স শেষ হওয়া ও সম্ভাব্য সেশনজটের কথা চিন্তা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো সময়ের দাবি। শুধু করোনাকালের এ সময়ে নয়, চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবিটি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় সংসদের ভেতরে-বাইরেও ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। চাকরির বয়স নিয়ে তরুণ জনগোষ্ঠীর জোর আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো সময় সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স যৌক্তিকভাবে বাড়ানোর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ওই পর্যন্তই!
চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯১ সালে। তখন চাকরিতে যোগদানের বয়স ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা হয়েছিল। যদিও তখন গড় আয়ু ছিল ৪৫ বছর। অতঃপর প্রায় ৩০ বছর পার হতে চলল। গড় আয়ুও এখন বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ব্যবসা, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, গড় আয়ু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এমনকি অবসরের বয়সসীমাও বেড়েছে। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বাড়ানো হয়নি। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলেছে। প্রত্যেক বছর গত বছরের চেয়ে আরও বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে চাকরির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ১৬০টিরও অধিক দেশে এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বছরের অধিক। বাস্তবতা এটাই যে, এদেশে বর্তমানে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষা আছে, সনদ আছে, কিন্তু চাকরি নেই! বয়স ৩০ পার হওয়া মানে যেন অর্জিত সার্টিফিকেটের মেয়াদ শেষ! তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখের বেশি কর্মক্ষম তরুণ-তরুণী বেকার। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ‘৩০’-এ বেঁধে রাখার ফলে সব শিক্ষার্থীর মেধা কি আদৌ কাজে লাগানো যাচ্ছে? চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো হলে যে যার দক্ষতা অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার ওপর নয়, উন্নত দেশগুলো দক্ষতার ওপর সবচেয়ে জোর দিয়ে থাকে।
করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া জীবনব্যবস্থায় সরকার অনেক সেক্টরে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করেছে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সম্ভাব্য সেশনজটের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, করোনাকালে লাখ লাখ চাকরিপ্রত্যাশী বেকার তরুণের চাকরির বয়স বিবেচনা ও দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবির প্রেক্ষাপটে এখনই চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা দরকার। বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে কোনো ধরনের ক্ষতির শঙ্কা নেই, বরং সব পর্যায়ের তারুণ্যের মেধা কাজে লাগালে দেশ এগিয়ে যাবে, বেকারত্ব কমবে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সুবিধাগুলো হলো ১. চাকরিতে যোগদানের বয়স বাড়লে সেশনজটের শিকার হওয়া তথা পড়ালেখা শেষ করা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণরা চাকরির পড়াশোনায় প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় পাবে। ২. উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ৩. শিক্ষিত বেকারের হার কমবে। ৪. রাষ্ট্র সব শিক্ষিত তরুণের মেধা কাজে লাগাতে পারবে। ৫. মেধা পাচার বন্ধ হবে। ৬. অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে। ৭. রাষ্ট্র দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশি সময় পাবে। ৮. তরুণরা নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেমন সময় পাবে, তেমনি বেশি বেশি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। ৯. গড় আয়ু অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার সমন্বয় হবে। ১০. বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনায় অবসরের বয়সসীমাও বাড়ানো যাবে। ১১. শিক্ষিত তরুণদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা গেলে বিদেশ থেকে কর্মী আনা বন্ধ হবে এবং। ১২. সর্বোপরি তরুণ জনগোষ্ঠী ও উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন সুদৃঢ় হবে।
সাধন সরকার, কলাম লেখক ও পরিবেশকর্মী