জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ইতিহাস। একাত্তরের পরাজিত শক্তি একদিন যে ভাষণ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল, সে ভাষণই আজ বিশ্বঐতিহ্য। পাকিস্তানের প্রেতাত্মা, তাদের পদলেহনকারী ও তোষামোদকারী-চাটুকাররা আর যেন ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ না পায়, সে জন্য বাংলার মানুষকে জাগ্রত থাকতে হবে। এ জন্য বাঙালি গর্বিত জাতি। বাঙালি জাতি এগিয়ে যাবে- এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্রোতের বিপরীতে লড়াইয়ের শক্তি গ্রথিত আছে এখানেই। এ ভাষণ এক অসাধারণ মহাকাব্য। ৪৮ বছর পরও যখন ৭ মার্চের ভাষণ রেডিও-টিভি আর মাইকে শোনা যায় তখন শিরায় শিরায় দেশপ্রেমের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
সেদিন যারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছিলেন তাদের রক্ত না জানি কীভাবে টগবগ করছিল। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে বিশ্লেষণ করার মতো রাজনৈতিক জ্ঞান আমাদের নেই। তবুও বলতে হয়, সেদিনকার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ একটা ভাষণ কীভাবে একটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে, কথাগুলো তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার হলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো।’
বাংলার মানুষের ভোটের অধিকারকে পাকিস্তানিরা কীভাবে প্রত্যাখ্যান করল, সেই ইতিহাস তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে। দোষ দেওয়া হলো আমাকে।’ একটা ভাষণই কীভাবে স্বাধীনতার দলিল হয়ে উঠে তার প্রমাণ ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
তবে রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মতো নিজে আক্রমণ না করে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল’ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবেয়ে রাখতে পারবা না।
নিজেদের শত্রুদের ব্যাপারেও সাবধান করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছেন, ‘মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবেন রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধু আসলেই বাংলার মানুষকে মুক্ত করেছেন। স্বাধীন করেছেন। সেই তিনিই তার ভাষণে বলেছেন, ‘আপনারা আমার ওপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন, জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করিনি। প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসিকাষ্ঠে আসামি করেও আমাকে নিতে পারেনি। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমাকে একদিন জেল থেকে বাইর করে নিয়ে এসেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্ত ঋণ শোধ করব।’ সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধুকে নিজের রক্ত দিয়েই ঋণ শোধ করতে হলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
তাই ৭ মার্চ ঐতিহাসিক মানদন্ডে বিশেষ অর্থবহ। সামগ্রিক দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। অসাধারণ এ বক্তব্য বঞ্চিত বাংলায় যেমন ঝড় তুলেছিল; তেমনি বৈশ্বিক পরিমন্ডলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। পাকবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবসহ সব মিত্রশক্তির কাছে সাবধানী বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শির উঁচানো বক্তৃতা। ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো। ফলে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্থান পেয়েছে।
কর্পোরেট সংবাদ/এনটি/