ড. এ কে আব্দুল মোমেন: দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরি। নিরাপদ পানি ও দক্ষ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে উন্নয়নের সুফল বাধাগ্রস্থ হয়। জনজীবন ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর পড়ে বিরূপ প্রভাব, রোগব্যাধী ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মকভাবে, হুমকির মুখে পড়ে জনস্বাস্থ্য। এ কারণেই ‘বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা-২০৩০’ বা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-৬ (এসডিজি) এ সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য গৃহিত হয়েছে।
সকলের জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি হচ্ছে এর ব্যবহার ও ব্যবহাকারীসহ জলচক্রের (ওয়াটার সাইকেল) দিকে পুরোপুরি দৃষ্টি দেওয়া। এর জন্য প্রথাগত খাতভিত্তিক উন্নয়ন ও সম্পদ থেকে সরে আসতে হবে এবং এসডিজি ১১.৫ লক্ষ্যমাত্রায় দেয়া পানি সম্পর্কিত দুর্যোগের সাথে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে মিঠা পানির প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসডিজি- ৬ সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সুনির্দিষ্ট পানযোগ্য পানি ও মৌলিক পয়ঃনিষ্কাশনের সাথে পানি, অপচয়িত পানি এবং ইকোসিস্টেমকে অন্তর্ভুক্ত করে। একটি টেকসই পানি-ভবিষ্যত বিনির্মানে এসডিজি-৬ একটি বড় পদক্ষেপ। এসডিজি- ৬ এর উদ্দেশ্য হলো; বাস্তু ও জনসাধারণের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যবিধি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলোকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করা। কারণ গুণগত মানসম্পন্ন টেকসই পানি সম্পদ এবং পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করা না গেলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র নিরোসনে এসডিজির অর্জনগুলোও বাধাগ্রস্থ হবে। জাতিসংঘের এসডিজি রিপোর্ট-২০১৭ অনুসারে বিশ্বে ৭১ শতাংশ মানুষ “নিরাপদ ব্যবস্থাপনা” পানি পরিষেবা এবং ৩৯ শতাংশ মানুষ “নিরাপদ ব্যবস্থাপনা” পয়ঃনিষ্কাশন পরিষেবা ব্যবহার করে। নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং দক্ষ পয়ঃনিষ্কাশন পরিষেবার গুরুত্ব বিবেচনা করে বিশ্বনেতারা নির্দিষ্ট কর্মকাঠামো ঠিক করেছেন।
২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপদেষ্টা পরিষদ (ইউএনএসজিএবি) পানি সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবেলার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সমন্বয়ে উচ্চ-স্তরের একটি জোট গঠনের সুপারিশ করেছেন। এই জোট পানির স্থিতিস্থাপকতা রক্ষা ও অভিযোজনে বৈশ্বিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দাভোসের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে জাতিসংঘের তৎকালিন মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান জিম ইয়ং কিম পানি ও স্যানিটেশন সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি-৬) অর্জনের জরুরী পদক্ষেপ হিসেবে হাই-লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার প্রতিষ্ঠায় তাদের আগ্রহের কথা ঘোষণা করেন। এইচএলপিডব্লিউ এর প্রধান কাজ হলো টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট- ৬ এবং অন্যান্য অভীষ্টগুলোর মধ্য থেকে পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠগুলো অর্জন করা। ২১ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে জাতিসংঘের সদর দফতরে দুই বছরের জন্য হাই-লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার (এইচএলপিডব্লিউ) চালু করা হয়। এতে ১১টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এশিয়া থেকে এইচএলপিডব্লিউ এর উচ্চপর্যায়ের প্যানেলে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে ২০০০-১৫ সময়কালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে অসামান্য সাফল্য অর্জন করে এবং এইচএলপিডব্লিউ এর ১১টি দেশের মধ্যে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
বহু বছর ধরে বাংলাদেশ সুপেয় পানির ব্যবহার এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষতার সাথে কাজ করে আসছে। আর্সেনিক আবিষ্কারের আগে এদেশে প্রায় সার্বজনীন পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত ছিল। খোলা জায়গায় মলত্যাগের ঘটনা এখন দেশে নেই বললেই চলে। এই ধরনের উন্নতির ফলে অভ্যন্তরীণ রোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। নিরাপদ পানি ব্যবহারের দক্ষতাও বেড়েছে।
আর্সেনিক দূষণ সমন্বয় করার পর বর্তমানে বাংলাদেশে ৮৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ খাবার পানি ব্যবহার করছে। এই অসাধারণ অগ্রগতি স্বত্ত্বেও এসডিজির যাত্রাকালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিরাপদ পানি সরবরাহের ভিত্তিতে সর্বনি¤œ স্তরে রয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছিল দ্বিতীয়। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সবেচেয় বেশি নিরাপদ খাবার পানি ব্যবহারে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভূটান এবং তারপরেই মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার অবস্থান। বাংলাদেশ নিরাপদ খাবার পানির শতভাগ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের যৌথ পর্যবেক্ষণে পরিচালিত ‘প্রোগ্রাম ফর ওয়াটার সাপ্লাই এ্যান্ড স্যানিটেশন’ (জেএমপি) অনুযায়ী, নিরাপদ পয়ঃনিষ্কাশন পরিষেবা হলো- জনসাধারণ কর্তৃক অন্য কোনো পরিবারের সাথে ভাগ না করে নিজস্ব উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন সেবার ব্যবহার, যেখানে পয়ঃনিসৃত ময়লা নিরাপদে নিষ্পত্তি করা হয়। ২০১৫ সালের জেএমপি রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করেছে, ১০ শতাংশ ব্যবহার করছে অস্বাস্থ্যকর টয়লেট, ২৮ শতাংশ অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে টয়লেট ব্যবহার করছে এবং ৬১ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকর উন্নত টয়লেট ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী একটি ভিত্তিরেখা (বেইজ লাইন) জরিপ পরিচালিত হয়েছিল, যেখানে দেখা যায় দেশে উন্নত স্যানিটেশনের আওতায় রয়েছে মাত্র ৩৩ শতাংশ মানুষ; ৪২ শতাংশ মানুষের ব্যবহারের জন্য কোনো ল্যাট্রিন নেই। এ থেকে বোঝা যায়, ২০০৩ সালের পরবর্তী সময়ে দেশে উন্নত স্যানিটেশন আওতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ শতাংশ।
বিবিএস এবং ইউনিসেফ এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৭৭ ভাগ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধাসহ পরিবারে বাস করছে। শহুরে এলাকায় এই হার ৮৬.৩ শতাংশ এবং গ্রামীণ এলাকায় ৭৪.৪ শতাংশ। তবে বিভাগ অনুযায়ী বরিশাল বিভাগের বাসিন্দারা অন্যান্য বিভাগের তুলনায় উন্নত স্যানিটেশন সুবিধাভোগে তুলনামূলক খানিকটা পিছিয়ে রয়েছে, এই অঞ্চলে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবহারের হার শতকরা ৫৮.৮ শতাংশ। উন্নত স্যানিটেশনের ব্যবহার সম্পদের সাথে দৃঢ়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে শতকরা ৯৫.৮ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা ব্যবহার করে। দরিদ্র পরিবারের যা ব্যবহারের হার তার চেয়ে প্রায় অর্ধেক কম (৪৫.৬ শতাংশ)। ব্যবহারের জন্য কোনো টয়লেট সুবিধা নেই এমন জনসংখ্যার হার সামগ্রিকভাবে যদিও খুব কম, তবুও রংপুর বিভাগের কিছু অতি দরিদ্র পরিবারের জন্য এটি এখনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে রয়েগেছে।
বাংলাদেশ এরইমধ্যে ‘দুর্গম এলাকার জন্য পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন জাতীয় পরিকল্পনা ২০১২’ প্রস্তুত করতে গিয়ে হাইড্রো-ভূতাত্ত্বিক এবং আর্থ-সামাজিকভাবে দুর্গম এলাকা এবং বাসিন্দা চিহ্নিত করেছে। গত চার বছর ধরে পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির (ওয়াশ) ওপর সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। স্বাস্থ্যবিধি সম্মত ধৌতের (ওয়াশ) জন্য মোট বার্ষিক উন্নয়ন (এডিপি) বরাদ্দ অর্থবছর ২০১৪-১৫ এর চেয়ে ৫.০৬ বিলিয়ন টাকা বাড়িয়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৪৬.১৯ বিলিয়ন টাকা। অন্যান্য বৈষম্য মোকাবেলার জন্যই স্যানিটেশন উন্নয়ন করা জরুরী। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিয়ে ভৌগলিকভাবে পৌছানো কঠিন যেমন- চর, হাওড়, উপকূলীয় এলাকা এবং পাহাড়ী অঞ্চলসহ এসব এলাকার জন্য ধৌত বিনিয়োগ (ওয়াশ ইনভেস্টমেন্ট) অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। সাশ্রয়ী মূল্যে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য উপযুক্ত টয়লেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এখনো বিরাট অবকাশ রয়ে গেছে এবং বিশেষত জলবায়ুর পরিবর্তনের হুমকিতে থাকা প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রবণ বিভিন্ন এলাকায় নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে গভীর মনযোগ প্রয়োজন। কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকায় এক মিলিয়নের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী হঠাৎ করেই খাবার পানি ও স্যানিটেশনের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে নিস্তারের পথ খুঁজছে বাংলাদেশ।
নিরাপদ পানির জন্য নদী সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ থেকে রেহাই পেতে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারে পুনঃস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে এরইমধ্যে। গত ৬০ বছর ধরে ট্যানারিগুলো ঢাকার হাজারিবাগে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল কিন্তু এই ট্যানারিগুলো থেকে নিঃসরিত বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে মিশে মারাত্বক দূষণ সৃষ্টি করায় এই স্থানান্তর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। শিল্প দূষণ থেকে একটি নদীকে বাঁচাতে সম্পূর্ণ একটি শিল্প ইউনিট স্থানান্তরের ঘটনা দেশে এই প্রথম উদাহরণ তৈরি করল। সাভারে ট্যানারি শিল্পকে ঘিরে একটি কেন্দ্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট (ইটিপি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে মেশার আগেই বর্জ্য ব্যস্থাপনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পানি সম্পদ সমৃদ্ধ একটি দেশ। এদেশে অভ্যন্তরীণ নবায়নযোগ্য পানি সম্পদের পরিমাণ ১০৫ ঘনমিটার/ বছর (জাতীয় পানি পরিকল্পনা ফেজ ২ এর ওপর ভিত্তি করে) যার মধ্যে ৮৪ ঘনমিটার পানি ভূ-পৃষ্ঠ এবং বৃষ্টিপাত থেকে প্রবাহিত এবং আনুমানিক ২১ ঘনমিটার পানি সম্পদ আসে ভূগর্ভস্থ প্রবাহ থেকে। দেশের সীমানার বাইরে থেকে আসা নদীর পানির প্রবাহের পরিমাণ বার্ষিক ১১০৫.৬৪ ঘনমিটার, যা দেশের মোট নবায়নযোগ্য পানি সম্পদের (আনুমানিক ১২১০.৬৪ ঘনমিটার) প্রায় ৯০ ভাগ। ২০০৮ সালে দেশের মোট পানি উত্তোলনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫.৮৭ ঘনমিটার, যার মধ্য থেকে ৩১.৫০ ঘনমিটার (৮৮ শতাংশ) ব্যবহার করা হয় কৃষিকাজে, ৩.৬০ ঘনমিটার (১০ শতাংশ) ব্যবহার করে নগর ও পৌরসভাগুলো এবং ০.৭৭ ঘনমিটার (২ শতাংশ) পানি ব্যবহৃত হয় শিল্পকারখানায়। দেশের মোট পানি উত্তোলনের ২৮.৪৮ ঘনমিটার বা ৭৯ শতাংশ আসে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে এবং ৭.৩৯ ঘনমিটার বা ২১ শতাংশ পানি আসে ভূপৃষ্ঠ থেকে। জিইডি-২০১৫ অনুসারে, ২০১০ সালে বাংলাদেশের মোট পানি সম্পদ ব্যবহারের অনুপাত ছিল ২.৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের মোট ৫৭টি আন্তঃসীমানা নদী রয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে এসেছে ৫৪টি এবং মায়ানমার থেকে এসেছে ৩টি নদী। এই নদীগুলোর মধ্য থেকে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর জন্য কার্যকর হবে এমন একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে যা ২০২৭ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এই চুক্তি মতে, প্রতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে সময়ের মধ্যে ভারত দশ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেবে, যাতে চুক্তিতে সম্মত পরিমাণ পানি বাংলাদেশে আসতে পারে। সে সময় ফারাক্কা পয়েন্টের নিচে পানির প্রবাহ পর্যবেক্ষণের জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যৌথ কমিটির দায়িত্ব ছিল চুক্তি অনুযায়ী পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো ধরণের সমস্যা তৈরি হলে তার সমাধান এবং ফারাক্কা বাঁধের কার্যক্রম তদারকি করা। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার স্বল্প পানি প্রবাহ সমস্যার সমাধানে দু’টি সরকার পারস্পারিক সহযোগতীর প্রয়োজনীয়তায় স্বীকৃতি দিয়েছে। একই সাথে সমতা, ন্যায্যতা এবং উভয় পক্ষের কারো কোনো ক্ষতি হবে না এমন শর্তে যৌথ নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি সংক্রান্ত নীতিমালায় উভয় সরকারই সম্মত হয়েছে।
চট্টগ্রামের হালদা নদী দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীভিত্তিক ইকোসিস্টেম। এটি বিশ্বের একমাত্র মিঠাপানির জোয়ার-ভাটা নদী যেখানে প্রধান প্রধান ভারতী কার্প জাতীয় মাছের ডিম প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইকোসিস্টেমের অবনতির কারণে মাছের ডিম সংগ্রহ ক্রমবর্ধমান হারে হ্রাস পাচ্ছে। এর পেছনে মানুষের বিভিন্ন নেতিবাচক কার্যক্রম বিশেষ করে, সেচের জন্য এই নদীর পানি ব্যবহার, অবৈধ মৎস আহরণ, নদী গর্ভস্থ বালি খনন, শিল্প দূষণ প্রভৃতির কারণে মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে ব্যহত হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নদী পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও স্থানীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে। নদী থেকে বালি উত্তোলন বন্ধ করা, যান্ত্রিক নৌ চলাচল, রাবার বাঁধ হ্রাস, মা মাছ সংরক্ষণে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধকরণ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এই ধরণের পদক্ষেপের জন্য এ বছর (২০১৮) হালদা নদীতে মাছের ডিম সংগ্রহে সর্বোচ্চ রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে।
বাংলাদেশে নিরাপদ পানি ও দক্ষ পয়ঃনিষ্কাশন পরিষেবার কাক্সিক্ষত মান অর্জন এবং বৈশ্বিক প্লাটফর্মে বাংলাদেশের মাননীয় এইচএলপিডব্লিউ সদস্যকে সহায়তা করার লক্ষ্যে প্রধান সচিবকে শেরপা করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে, যেখানে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তা এবং নামকরা বিশেষজ্ঞরাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। শেরপা ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করেন, যার কাজ হলো পরবর্তী দুই বছর এইচএলপিডব্লিউতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ কাজে সহায়তার জন্য জাতীয় কর্মশালা আয়োজন করে তার মাধ্যমে একটি রোম্যাপ প্রস্তুত করা। উক্ত কর্মশালায় বুদ্ধিবৃত্তিক এবং যৌক্তিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সেন্টার ফর এনভাইরনমেন্টাল এ্যান্ড জিওগ্রাফিক সার্ভিস (সিইজিআইএস)কে নিযুক্ত করা হয়েছে। এসডিজি ৬ এর দুইটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং ছয়টি ভিন্ন লক্ষ্য পূরণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের সিদ্ধান্তও গৃহিত হয়েছে।
হাই-লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার (এইচএলপিডব্লিউ) কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ দু’টি লাইট হাউস উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একটি হলো নিরাপদ খাবার পানি নিশ্চিতকরণ এবং স্থানীয় আবহাওয়া শীতল রাখতে পুকুর খনন ও পুনঃখনন, অন্যটি বিদ্যালয়ে ওয়াশ ডিপার্টমেন্ট উন্নয়ন। প্রথম উদ্যোগের আওতায় প্রতিটি মৌজায় কমপক্ষে একটি পুকুরকে দূষণ থেকে রক্ষা করা হবে। এটা হবে খাবার পানি এবং অন্যান্য গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত নিরাপদ পানির উৎস। এই সুরক্ষিত পুকুরে বাইরে থেকে কোনো ময়লা পানি প্রবেশ করতে পারবে না। শুধুমাত্র বৃষ্টির পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানির অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এই পুকুরে পানির যোগান ঠিক থাকবে। আর দ্বিতীয় প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার দেশের স্কুলগুলোতে বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি আদর্শ ওয়াশ স্থাপন করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) একটি প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রোগ্রাম (পিইডি) গ্রহণ করেছে, যার আওয়তায় ‘ওয়াশ ব্লক’ নামে একটি দারুণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা নিরবিচ্ছিন্ন পানিসহ আলাদা টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা পাবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের প্রধান সংস্থা ও সহ-বাস্তবায়নকারী হিসেবে কাজ করছে।
বিগত সময়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী দারুণভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই স্বীকৃতির অংশ হিসেবেই বাংলাদেশের উন্নয়নের রূপকার, বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট- ৬ এর জন্য এইচএলপিডব্লিউ সদস্য করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের জন্য বিরাট অর্জন। পানি সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এরইমধ্যে এসডিজি-৬ এর লক্ষ্য ৬.৩ (পানির মান উন্নয়ন) এবং লক্ষ্য ৬.৬ (জলবাস্ত সংরক্ষণ) সংক্রান্ত দুইটি প্রধান উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে। সকলের জন্য শতভাগ নিরাপদ স্যানিটেশন পরিষেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।