একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৫২ সালে এ দেশের মুক্তিকামী দেশপ্রেমিক দামাল ছেলেরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য জীবন দিয়ে এ দিনকে করেছে মহিমান্বিত। একুশ বাংলাদেশের গণমানুষের হৃদয়ের গভীরে গ্রথিত এক চেতনা।একুশ উপলক্ষে আয়োজিত গ্রন্থমেলা একুশকে স্মরণেরই এক মনোজ্ঞ উপায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি মানে বইমেলার উৎসব। বাংলাদেশে হাজারো মেলার মাঝে বইমেলার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটছে মূলত এ মেলাকে কেন্দ্র করে। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতিবোধ ও ঐতিহ্য হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলার ভিত্তি। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের কাছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা এক সেরা উৎসব। সবারই মিলনমেলা বাংলা একাডেমির বইমেলা। এ দেশের সব শ্রেণির পাঠক সারা বছর অপেক্ষা করে থাকে কখন বসবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা, কবে বসবে বাঙালির মিলনমেলা। ভাষা আন্দোলন, বাংলা একাডেমি আর একুশের গ্রন্থমেলা একই সূত্রে গাথা। একুশের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ফসল বাংলা একাডেমি। একুশে গ্রন্থমেলা বিকশিত হয়েছে বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে। নবগঠিত বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক জাগরণের প্রথম প্রকাশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ একটি দিন একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে রয়েছে বাঙালির দীর্ঘকালের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের এই মাসেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রস্তুত হচ্ছিল ছাত্র-জনতা। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সমর্থন দিয়েছিল আপামর বাঙালি। দিন যত যেতে থাকে ভাষা আন্দোলন তত গতি পেতে থাকে। বায়ান্নর অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। শুরু করেছিল আমরণ সংগ্রাম।
এ ছাড়া বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষায় রূপ দিতে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল অনেকে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদ দিবসে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা। দিনটি পালিত হতে থাকে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা, ব্যাপক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে মহান একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। একই বছর ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের নাম। এরপর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে ভাষাশহিদ দিবসের মর্যাদা। বেগবান হয় আবহমান বাংলার ঐতিহ্য; একুশে ফেব্রুয়ারি হয় বিশ্বনন্দিত। ২০০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষা আজ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে একুশের গ্রন্থমেলাও এক নতুন ধারায় প্রবেশ করতে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং অমর একুশের গ্রন্থমেলা একই সূত্রে গাথা হয়ে যায়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ সালের বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব? ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে বইমেলা তত দিনে মাসব্যাপী একটি উৎসবে রূপ পেয়েছে? তবে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এসে মেলার বারোয়ারি রূপটি এতটাই প্রকট হয়েছিল যে, স্টলগুলো থেকে উচ্চৈঃস্বরে বাজানো কবিতা ও গানের ক্যাসেটে কান পাতা দায় ছিল? ভেঁপু-বাঁশির সুর শোনা যেত টিএসসি কিংবা দোয়েল চত্বরে পৌঁছার আগেই? পুরো শাহবাগ থেকেই শুরু হয়ে যেত শিলপাটা থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের পসরা?
সম্ভবত ১৯৯৭ সালে বইমেলাকে শুধুই বইয়ের মেলায় রূপান্তরের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল? বাংলা একাডেমির সেই সময়কার মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে উদ্যোগটা সফল করতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়? আমিও ঠিক ওই বছর বইমেলা প্রতিবেদন লিখে ভোরের কাগজে চাকরি পাওয়ার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই? আমার মনে আছে, বাংলা একাডেমির ছোট্ট চত্বরেই সেবার বইমেলাটি বেশ বড় লাগছিল? মেলা শুরুর দু-চার দিনের মধ্যেই আমি একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল কোকিলেরও ডাক শোনা যায়? মহান ভাষা আন্দোলনের স্বাক্ষর হিসেবে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিজুড়ে চলবে একুশের গ্রন্থমেলা। এ মাসটির জন্যই যেন পুরো একটি বছর অপেক্ষা করে দেশের বাংলা ভাষাপ্রিয় মানুষ। লেখক, প্রকাশকরাও একুশের মেলায় তাদের শ্রেষ্ঠ বইটি উপহার দিতে নিরন্তর কাজ করে যান। একুশের গ্রন্থমেলায় বিভিন্ন স্টলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশের প্রবীণ-নবীন লেখকের নানা ধরনের বইয়ের পসরা বসে। মেলায় সমবেত হন বাংলাদেশের বাংলাপ্রেমী লেখক, পাঠক। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তার পরও স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা বায়ান্নর আত্মত্যাগের অভিযাত্রার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি; বরং ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি আমাদের বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি। পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণে আমাদের অর্জিত গৌরবও অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে। বাংলার চেয়ে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী নতুন প্রজন্ম। বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্রে তাদের উৎসাহ কম। বছর ঘুরে আবার এলো বাঙালির প্রিয় মাস ফেব্রুয়ারি; শুরু হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
এবার বেশ কিছু আগেই প্রকাশকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের নির্ধারিত স্টল বা প্যাভিলিয়ন। অমর একুশের গ্রন্থমেলার পরিধি সম্প্রসারিত হয়ে বাংলা একাডেমির চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অবধি বিস্তৃত হয়েছে। অমর একুশের গ্রন্থমেলাকে এ অবস্থায় পৌঁছতে পেরোতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সেকালের বর্ধমান হাউস আজকের বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বটতলায় এক টুকরা চটের ওপর চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত আজকের মুক্তধারা প্রকাশনী কলকাতা থেকে আনা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা মাত্র ৩২টি বই নিয়ে যে একুশের গ্রন্থমেলার শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ অনেক বিস্তৃত। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি ১৫ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি এক সপ্তাহের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রি করে একুশের গ্রন্থমেলার ধারা অব্যাহত রাখে এবং ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একাডেমি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে, যা উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রকাশকদের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে একুশের গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয় এবং ১৯৭৯ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। সময়ের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় মহান একুশের গ্রন্থমেলা আজকের স্বকীয়তা নিয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে। এবার একুশে গ্রন্থমেলা বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হওয়ায় এর ব্যাপকতা সব বাংলা সাহিত্যপ্রেমীর মনে আশার সঞ্চার করে।
উল্লেখ্য, সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও আমরা ব্যর্থ হয়েছি বাংলাদেশের অফিস-আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে। উপরন্তু কখনো বাংলা ভাষা হচ্ছে অনাদৃত, অবহেলিত। দেশজুড়ে আজ সর্বত্র ইংরেজি সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি। তাছাড়া বিজ্ঞাপন, প্রচারপত্রে বাংলা ব্যবহারে চরম উদাসীনতা লক্ষণীয়। দেশে প্রকাশিত, মুদ্রিত বাংলা বইয়ে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি এবং অসংগতি চোখে পড়ে। বাংলা বানানেও আজ অবধি প্রতিষ্ঠিত হয়নি একটি জাতীয় মান। তার পরও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে দেশজুড়ে শুরু হওয়া ভাষাশহিদদের কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করার নানা আয়োজন, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের গ্রন্থমেলা থেকে বয়স নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের অগণিত বাংলা বই কেনা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়া বাংলার ঐশ্বর্যের মূল্য অনেক। আগামীতে বইমেলার গুণমানে বৃদ্ধি পাবে এর বিশালতা।
দিন দিন সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে বাংলা সাহিত্যচর্চা। বাংলা ভাষা সাহিত্যে দেশে অনেক বিশ্বমানের লেখক থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাহিত্য এখনো বিশ্বে তেমন সুপরিচিত নয়। তাই বাংলা ভাষার সাহিত্যকে বিশ্বের পরিমন্ডলে ছড়িয়ে দিতে মাতৃভাষা চর্চা, গবেষণাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলায় লিখিত ভালো বইগুলো বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের ওপর জোর দিতে হবে। তেমনি বিদেশি বিভিন্ন উন্নত মানের বইকে বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের একুশের গ্রন্থমেলাকে আন্তর্জাতিক বইমেলায় রূপ দিতে এখানে বিদেশি প্রকাশকদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির বিশেষ উদ্যোগের বিকল্প নেই। শুরু হওয়ার পর থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা আপামর বাঙালির কাছে প্রাণজোয়ার সৃষ্টিকারী এক মেলায় পরিণত হয়েছে। বাঙালি লেখক, প্রকাশক এবং পাঠকদের কাছে বইমেলা এক মিলনমেলা। বইমেলায় জড়ো হতে থাকে দূর-দূরান্তের চেনা মুখগুলো। ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারি পার হলে ভাঙে এ মিলনমেলা। বইমেলা আমাদের অন্তরে যে বন্ধন তৈরি করে, তা ভাঙে না কখনই। দেশের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে। অনুপ্রেরণা জোগায়।