মো: মিজানুর রহমান, এফসিএস : আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত এবং প্রকাশের উপর ২০১৮ সালের ২০ জুন জারি করা নোটিফিকেশনের গেজেট প্রকাশ করেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। যেখানে বিস্তারিত ভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে কখন কীভাবে কত সময়ের মধ্যে আর্থিক বিবরণী ও মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রস্তুত এবং প্রকাশ করতে হবে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন অবাদ প্রবাহ ও ব্যাপক প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সর্বস্তরের বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা তৈরি করেছে বিএসইসি। উল্লেখিত নোটিফিকেশনে প্রদত্ত নির্দেশনা পরিপালনে সর্বসাধারণের জ্ঞাতার্থে যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিএসইসি কর্তৃক নিয়েছে, তা নোটিফিকেশনটি পুরোপুরি বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। বিএসই কর্তৃক এ ধরনের পদক্ষেপ ও নির্দেশনা সর্বমহলে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু দেখার বিষয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর্তা-ব্যক্তিরা বিএসইসি‘র এই নির্দেশনা সঠিক ভাবে পরিপালন করেন কিনা?
নোটিফিকেশনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এর ৩ নং অনুচ্ছেদে ১ নং কলামে বলা হয়েছে প্রতিটি কোম্পানি প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী অনুমোদনের জন্য পরিচালনা পর্ষদের সভা ডাকার তিন কার্যদিবস পূর্বে স্টক একচেঞ্জ এবং বিএসইসিকে পর্ষদ সভার তারিখ এবং সময় সম্পর্কে অভিহিত করবে।
নোটিফিকেশনের ৩(২) এর প্রথম অনুচ্ছেদে বলা আছে, পরিচালনা পর্ষদ সভায় প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী অনুমোদনের সময় একই সভায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) এর ঘোষণা করতে হবে। অর্থাৎ একই সভায় প্রত্যেক প্রান্তিকের আর্থিক বিবরণী এবং তার সাথে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ঘোষণা করতে হবে।
আবার নোটিফিকেশনের ৩(২) এর শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ঘোষণাকৃত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করার সময় ঠিক তার পূর্বের বছরের একই সময়ের শেয়ার প্রতি নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি), শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ার প্রতি নিট অপারেটিং নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) এর সাথে পাশাপাশি তুলনা করে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আকারে প্রকাশ করতে হবে।
যদি কোন কোম্পানি প্রত্যেক প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় ওই কোম্পানির তুলনামূলক শেয়ারপ্রতি নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) প্রকাশ না করে তাহলে বিএসইসি’র প্রদত্ত নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে গণ্য হবে। সুতরাং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত এবং প্রকাশের পূর্বে কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিএসইসি’র নোটিফিকেশনটি ভালো ভাবে পড়ে বুঝতে হবে। সে মোতাবেক কাজ করতে হবে।
নোটিফিকেশনের অনুচ্ছেদ ৪ এ বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানিকে (জীবন বীমা কোম্পানি ব্যতিত) প্রথম প্রান্তিক শেষ হওয়ার পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিক শেষ হওয়ার পরবর্তী এক মাসের মধ্যে তা প্রকাশ করতে হবে। যা স্টক এক্সচেঞ্জ ও বিএসইসিকে অভিহিত করতে হবে এবং কমপক্ষে একটি বাংলা, একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি প্রান্তিকে আর্থিক বিবরণী ও তুলনামূলক মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশ এবং প্রচার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া কোম্পানি চাইলে একাধিক পত্রিকায়ও তা প্রকাশ করতে পারবে।
নোটিফিকেশনের ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অর্থবছর শেষ হওয়ার পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে অডিটের কাজ শেষ করতে হবে। কোম্পানির আর্থিক বিবরণী অডিট শেষ হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১২০ দিন পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী স্টক একচেঞ্জ ও বিএসইসিতে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রেও শেয়ারপ্রতি নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) ঘোষণা করতে হবে।
নোটিফিকেশনের ৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আর্থিক বছর শেষ হওয়ার পর যে সভায় বার্ষিক আর্থিক বিবরণী অনুমোদন নেওয়া হবে, সেই পর্ষদ সভার ৭দিন পূর্বে স্টক একচেঞ্জ ও বিএসইসিকে সভার তারিখ, স্থান ও সময় অভিহিত করতে হবে। একই পর্ষদ সভায় আর্থিক বিবরণী অনুমোদনের পাশাপাশি ঘোষণাকৃত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করার সময় ঠিক তার পূর্বের বছরের একই সময়ের শেয়ারপ্রতি নিট অ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি), শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) এবং শেয়ারপ্রতি নিট অপারেটিং নগদ প্রবাহ (এনওসিএফপিএস) এর সাথে পাশাপাশি তুলনা করে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আকারে প্রকাশ করতে হবে। কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) সংক্রান্ত তথ্যের বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী এবং বিগত বছরের সাথে তুলনামূলক মূল্য সংবেদনশীল তথ্য কমপক্ষে একটি বাংলা, একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা ও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করতে হবে।
নোটিফিকেশনের ৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন এবং মূল্য সংবেদনশীল তথ্য কোম্পানির ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করতে হবে।
নোটিফিকেশনের ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত প্রতিটি কোম্পানি তার বার্ষিক প্রতিবেদন এজিএমের কমপক্ষে ১৪ দিন পূর্বে কোম্পানির ওয়েবসাইটে দিবে। এছাড়া স্টক একচেঞ্জ ও বিএসইসিকে অভিহিত করবে এবং প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর ইমেইলে বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। বিনিয়োগকারীদের বার্ষিক প্রতিবেদন ও এজিএম সম্পর্কে জানানোর জন্য বিশেষ বিজ্ঞপ্তি আকারে কমপক্ষে দুইটি দৈনিক পত্রিকায় (একটি বাংলা, একটি ইংরেজি) এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করতে হবে। অর্থাৎ বার্ষিক প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত যে সকল ডকুমেন্টারি তথ্য অন্তর্ভুক্ত আছে যেমন- এজিএম’র নোটিশ, আর্থিক বিবরণী, পরিচালনা পর্ষদের প্রতিবেদন, নিরীক্ষা প্রতিবেদন, কর্পোরেট গর্ভনেন্স সার্টিফিকেট বা কমপ্লায়েন্স অডিট সার্টিফিকেট, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) কর্তৃক প্রদত্ত ঘোষণাসহ সকল তথ্যদি কোম্পানির ওয়েবসাইটে, স্টক এক্সচেঞ্জ, বিএসইসি এবং প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর ইমেইলে বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠাতে হবে, যা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করতে হবে।
নোটিফিকেশনের সার্বিক পর্যালোচনায় পরিষ্কার বোঝা যায় যে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপক্ষ বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ধরে রাখার জন্য এবং শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা যেন সার্বিক ভাবে কোম্পানির সকল তথ্য কোনো না কোনো ভাবে পড়তে বা জানতে পারে এবং কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি জেনে বুঝে শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারেন তারই বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং যারা পুঁজিাবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সম্পৃক্ত আছেন এবং যারা ভবিৎষ্যতে সম্পৃক্ত হবেন তারা যদি প্রতিটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত ও প্রকাশের ক্ষেত্রে বিএসইসি কর্তৃক নির্দেশিত নির্দেশনা যথাযথ ভাবে পরিপালন করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা সবাই রাখতে পারেন। ইতিমধ্যে বেশকিছু তালিকাভুক্ত কোম্পানি যেমন- ইর্স্টান ব্যাংক লিমিটেড, জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, উইনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ইফাদ অটোস লিমিটেডসহ আরো অনেক কোম্পানি বিএসইসি‘র এই নির্দেশনা মোতাবেক প্রতি কোয়াটারে আর্থিক বিবরণী ও মূল্য সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশ করছে। কিন্তু এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানিকেই শেয়ারবাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে ও বিনিয়োগ সুরক্ষায় নোটিফিকেশনের নির্দেশিত নির্দেশনা পরিপাালন করা উচিৎ।
এখানে লক্ষনীয় যে, বিএসইসি‘র নির্দেশনাটি সময় উপযোগী এবং যতার্থ হলেও নির্দেশনাটির প্রচার প্রচারণায় তাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি মিডিয়া, ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি), ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি), ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি), শেয়ার ট্রেডিং হাউজ ও স্টক এক্সচেঞ্জ কেউ-ই তাদের পক্ষ থেকে এই নোটিফিকেশনের বিষয়ে ওয়ার্কশপ-সেমিনার করেনি। এছাড়া মিডিয়ায় প্রচার প্রচারণা যেভাবে হওয়া প্রয়োজন ছিল সেভাবে হয়নি। ফলে বিএসইসি‘র এই নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন কার্যত হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে বিএসইসি‘র নোটিফিকেশন ও নির্দেশনা প্রচার প্রচারণার বিষয়টি কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ, বিএসইসি, শেয়ার ট্রেডিং হাউজ, পেশাজীবী সংগঠন, যেমন; আইসিএবি, আইসিএমএবি, আইসিএসবি, ডিএসই, সিএসই ও পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনকে এই বিষয়ে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ করতে হবে এবং মিডিয়াকে প্রচার প্রচারণায় ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে কেবল নির্দেশনাটির যতার্থ মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
লেখক: সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ ডটকম; ফেলো, আইসিএসবি ও কলামিস্ট
বিএসইসি‘র ২০-০৬-২০১৮ তারিখের নোটিফিকেশনটি দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন
আরও পড়ুন:
যোগ্যতা নির্ধারণ ছাড়াই সিএফও এবং কোম্পানি সেক্রেটারি নিয়োগ বাধ্যতামূলক