September 20, 2024 - 5:40 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeকর্পোরেট ভয়েসস্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্যাটেন্ট ফি মওকুফ করা প্রয়োজন: অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্যাটেন্ট ফি মওকুফ করা প্রয়োজন: অধ্যাপক আ ব ম ফারুক

spot_img
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে কর্মজীবন শুরু করেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে। বর্তমানে ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কর্মজীবনের বিভিন্ন সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ডিন, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি বাংলাদেশের ওষুধনীতি, ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টে বাংলাদেশের ৩৪টি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি একসঙ্গে নিষিদ্ধ হওয়া, ওষুধের জেনেরিক প্যাটেন্ট ফি ও ওষুধশিল্পের অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের বর্তমান বাজার সম্পর্কে কিছু বলুন।
আ ব ম ফারুক: আমাদের ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সারা বিশ্বে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। শুরুর দিকের গল্পটা বলতে গেলে প্রথমে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর প্রতিষ্ঠার সময়টার কথা বলতে হবে। ওষুধ-সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ, মান উন্নয়ন ও একটা কাঠামোগত রূপ দেওয়ার জন্য ১৯৭৩ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটিকে এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন, আমদানি করা ওষুধ বাছাই, মান-পরিমাণ ও দাম নির্ধারণের মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। পরে এ কমিটির সুপারিশে ওষুধের আমদানি কমিয়ে দেশে মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন বাড়ানো এবং এ শিল্পকে সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে ‘ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল একটি ছোটখাটো পরিদফতর। পরিদফতর হিসেবে এটি দীর্ঘদিন কাজ করেছে। পরে ২০০৯ সালে সরকার এর কাজের ব্যাপ্তি ও পরিধি চিন্তা করে একে অধিদফতরে রূপান্তর করে। ১৯৭৪ সালে যখন এ পরিদফতর আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে, তখন বাংলাদেশে ওষুধের বাজার ছোট ছিল, জনসংখ্যা কম ছিল, ওষুধ কোম্পানির সংখ্যাও ছিল কম। তখন ওষুধের বাজার সব মিলিয়ে ১৬৫-১৭০ কোটি টাকার মতো ছিল। তারও আগে ১৯৭২ সালে এ বাজার ছিল ১৫০ কোটি টাকা বা তার কিছু বেশি। অথচ বর্তমানে দেশে এ শিল্পের বাজার প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তার মানে, আমাদের ওষুধশিল্পের বাজার এখন বিশাল।
প্রশ্ন : এ শিল্পের দ্রুত বিস্তৃতির পেছনে কোন কোন পদক্ষেপ উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন?
আ ব ম ফারুক: ওষুধশিল্পের বিস্তৃতির পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ১৯৮২ সালে প্রণীত জাতীয় ওষুধনীতি। এটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ওষুধনীতি, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাছ থেকে বিপুল প্রশংসা ও সমর্থন পায়। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশে ওষুধশিল্প একটি দ্রুত বিকশিত খাত। একটা সময়ে যেখানে দেশের বার্ষিক চাহিদার ৮০ শতাংশ আমদানি করা হতো, সেখানে এখন ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের গুণগত মান রক্ষাসহ বিশ্বের ১২৭টি দেশে রফতানি হচ্ছে। ওষুধশিল্পে এ বিপ্লব সম্ভব হয়েছে শুধু ওই নীতির কারণে। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি অনুসারে, যদি কোনো ওষুধ দেশীয় প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে উৎপাদন করা যায়, তাহলে তা কোনোভাবেই আমদানি করা যাবে না। এ নীতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে দেশীয় ওষুধশিল্পে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষেত্রে।
প্রশ্ন : সম্প্রতি হাইকোর্ট এক আদেশে বাংলাদেশের ৩৪টি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি নিষিদ্ধ করেছেন। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
আ ব ম ফারুক: আসলে এ কোম্পানিগুলো অনুমোদনের পর সেগুলো পর্যবেক্ষণ করার মতো কেউ ছিল না বলে এখন একসঙ্গে এতগুলো কোম্পানি নিষিদ্ধ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলোর বাজারজাত করা ওষুধ এখনও বাজারে রয়ে গেছে। এটা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি। আমাদের দেশে সব বিষয়েই আইন আছে; কিন্তু সেটা ঠিকমতো প্রয়োগ হচ্ছে কি না, তা দেখার মতো কেউ নেই। যে কারণে প্রতিষ্ঠিত এ শিল্পটি আস্থা সংকটে পড়তে পারে বলে আমার মনে হয়।
প্রশ্ন : একসঙ্গে এতগুলো কোম্পানি নিষিদ্ধ হওয়ায় ওষুধ রফতানি শিল্পে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন কি?
আ ব ম ফারুক: হ্যাঁ, কিছুটা তো পড়বেই। একই সঙ্গে বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে। আমরা দেখেছি, ১৯৮২ সালের ওষুধনীতির ফলে দেশে একসঙ্গে এক হাজার ৭০৭টি ওষুধ নিষিদ্ধ হয়েছিল। তখন সব মিলিয়ে আমাদের দেশে উৎপাদিত ওষুধের সংখ্যা ছয় হাজারের বেশি ছিল না। সবাই ধারণা করেছিলেন, দেশে ওষুধের একটা বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ হবে। মানুষ যথাযথ ওষুধ পাবে না চিকিৎসার জন্য। কিন্তু আমরা দেখেছি, সেরকম কিছু হয়নি। কেননা যেসব ওষুধ নিষিদ্ধ হয়েছিল, তার বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর। তাই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আমাদের বড় ধরনের কোনো ঝুঁকিতে পড়তে হয়নি। অবশ্য যে কোনো দেশের জন্য একসঙ্গে এতগুলো ওষুধ নিষিদ্ধের ঘটনা ছিল বাংলাদেশে প্রথম। তাই একসঙ্গে ৩৪টি কোম্পানি নিষিদ্ধ হলেও বাজারে এর প্রভাব অল্পই পড়বে বলে আমার বিশ্বাস। বরং যেসব দেশে ওষুধ রফতানি হয়, তাদের কাছে বিষয়টি আরও আস্থার জায়গা তৈরি করবে যে, এখানে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে সরকার সজাগ। তাই উচ্চ আদালতের এ ধরনের সিদ্ধান্তে ওষুধ রফতানিতে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না।
প্রশ্ন : নিষিদ্ধ হওয়া কোম্পানিগুলোর ওষুধ এখনও বাজারে রয়েছে। মানুষ এখনও এ সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত নয়। এ ব্যাপারে আপনার মত কী?
আ ব ম ফারুক: মানুষ যে এ সম্পর্কে অবগত নয়, এর সঙ্গে আমি একমত নই। কেননা ইতোমধ্যে পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট খবর সবার কাছে পৌঁছে গেছে। সমস্যাটি আসলে সে গোষ্ঠীকে নিয়ে নয়, যারা খবরটা জানে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে এবং আপনি খোঁজ নিলে জানবেন পৃথিবীর কোনো বিষয় নিয়েই যেন তাদের মাথাব্যথা নেই, সচেতনতা নেইÑভয়ের বিষয়টি হচ্ছে তাদের নিয়ে। তাই এসব কোম্পানি তাদের পণ্য যেন গ্রামাঞ্চলে বাজারজাত করতে না পারে, সেদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিদিন মনিটর করতে হবে এবং সবচেয়ে সহজ হবেÑযদি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া যায়, যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এরা তাদের পণ্য বাজারমুক্ত করতে পারে। ইতোমধ্যে আদালত থেকে আমাকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, প্রতি তিন মাস পর নিষিদ্ধ হওয়া কোম্পানিগুলোর ওষুধ বাজারে আছে কি না, এ সম্পর্কে প্রতিবেদন জমা দিতে। তাছাড়া ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনেরও উচিত জাতীয় দৈনিকগুলোতে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন দিয়ে সবাইকে নিষিদ্ধ কোম্পানিগুলো সম্পর্কে সচেতন করা।
প্রশ্ন : সম্প্রতি সিপিডি তাদের বার্ষিক পর্যালোচনায় বলেছে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় সাত লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে ড্রাগ রেসিস্টেনস ভাইরাসের কারণে। বাংলাদেশে ‘ড্রাগ ইমপিউরিটিস’ নির্ণয়ে কোম্পানিগুলোর আধুনিক কোনো ল্যাব আছে?
আ ব ম ফারুক: বাংলাদেশে অনেক কোম্পানি ডব্লিউএইচও স্ট্যান্ডার্ড মেনে কাজ করছে; যে কারণে এত স্বল্প সময়ে আমরা সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এসব কোম্পানির নাম আমরা সবাই জানি। একই সঙ্গে এটাও বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানিরই সঠিক মানের ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা নেই। তাহলে প্রশ্নটা আসে, তারা কাজ করছে কীভাবে? আসলে যাদের মান নির্ণয়ের যথেষ্ট উপকরণ নেই, তারা একটা নির্দিষ্ট ফি দিয়ে বড় কোম্পানির সহযোগিতা নিচ্ছে এবং সেখান থেকে ওষুধের মান পরীক্ষা করে পণ্য বাজারজাত করছে। টেকনোলজি ট্রান্সফারের এ বিষয়টি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সবখানেই আছে।
প্রশ্ন : বিভিন্ন ওষুধের ‘জেনেরিক প্যাটেন্টে’র জন্য ফি দিতে হলে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
আ ব ম ফারুক: সদ্যস্বাধীন একটি দেশের পক্ষে তখন প্যাটেন্ট কিনে ওষুধ উৎপাদন সম্ভব ছিল না। যে কারণে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এসব প্যাটেন্ট নিয়ে চিন্তা না করে যেন ওষুধ উৎপাদন করা হয়। তিনি একই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান দেশে ওষুধ উৎপাদন করতে চায়, তাহলে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হবে। যে কারণে আমাদের দেশে একের পর এক ওষুধ কারখানা গড়ে উঠেছে এবং সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের জন্য ওষুধের জেনেরিক প্যাটেন্ট ফুল ফ্রি করা আছে ২০৩২ সাল পর্যন্ত। তার পরও আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য বড় একটা বিপদ আসবে বলে শঙ্কা থেকেই যায়। কারণ ১৯৭২ সালে একটি ট্যাবলেটের দাম যত ছিল, ২০১৭ সালে এসেও এর দাম প্রায় একই। কিন্তু উন্নত দেশগুলো থেকে যদি প্যাটেন্ট কিনতে হয়, তাহলে এর দাম হবে এখনকার দামের চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। তাই আমার মতামত হচ্ছে, অন্তত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য প্যাটেন্ট ফি মওকুফ করে দেওয়া হোক।
প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আ ব ম ফারুক: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সূত্র: শেয়ার বিজ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ