বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিজয়ের মাসে আনন্দের পাশাপাশি নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে দেশজুড়ে। এবারের নির্বাচন নানা কারণে বেশ গুরুত্ব বহন করছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র নির্বাচন। জনগণ ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত করবেন সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্যরা সংসদে বসে দেশ পরিচালনার জন্য তৈরি করবেন জনকল্যাণমূলক আইন, নীতি। বিগত নির্বাচন নিয়ে এদেশের জনগণের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং শক্তিশালী বিরোধী দল-যার উপস্থিতি পুরোপুরি পরিলক্ষিত হয়নি।
বিগত সরকারের সময় যে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তা প্রতিটি মানুষ বিশ^াস করে। কিন্তু সুস্থধারার রাজনৈতিক চর্চার অভাবে জনগণের কাছে বিষয়টি হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দিতে পারে। এদেশের জনগণ বরাবরই শান্তিপ্রিয় এবং দেশপ্রেমিক। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধে কিছু বিপথগামী ছাড়া প্রত্যেকেরই ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ বা সমর্থন। এছাড়া প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জনগণের যে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, তা কোন রাজনৈতিক দলের নেতা অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু নিকট অতীতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অদূরদর্শীতা এবং ভুল সিদ্ধান্ত অনেক সময় এদেশের জনগণকে শঙ্কিত করে তোলে।
জনগণ যেমন উন্নয়ন দেখতে চান, তেমনি দেখতে চান সুস্থধারার রাজনৈতিক চর্চা। ক্ষমতার পালা বদলে জনগণের ভূমিকাই মূখ্য। কারণ, জনগণই ক্ষমতার মূল উৎস। কিন্তু সেই জনগণ যখন নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন, আতঙ্কিত হন-তখনই দেশের রাজনীতি পড়ে হুমকির মুখে।
বর্তমান রাজনীতি এবং নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। সরকার বিরোধী জোটের অভিযোগ, তাঁরা পুলিশী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে মিথ্যে মামলা, গ্রেফতার করা হচ্ছে দলীয় নেতা-কর্মীদের। এছাড়া সরকার দলীয় নেতা-কর্মীরা বিরোধী জোটের নির্বাচনী প্রচারণায় হামলা চালাচ্ছেন, বাধা দিচ্ছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও মিডিয়ার কল্যাণে এসব অনেক খবরেরই সত্যতা প্রকাশ পাচ্ছে। বিষয়টি সুষ্ঠ নির্বাচনের সুস্পষ্ট অন্তরায়।
অন্যদিকে সরকার দলীয় জোট বিরোধী জোটের উপর অভিযোগ আনছে, তাঁরা নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীদের কাছে অভিযোগ করে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে।
পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্যে একটা বিষয় পরিস্কার হয় যে, কোন জোটই বোধ হয় জনরায়ের প্রতি নিজের আস্থা রাখতে পারছেন না। একটা অজানা শঙ্কা কাজ করছে তাঁদের মনে। সরকারের উন্নয়নে জনগণ খুশি হলে জনরায় নিশ্চয়ই তাঁদের পক্ষে যাবে-এই বিশ্বাসের প্রতি কোথায় যেন একটা কিন্তু কাজ করছে সরকারী জোটের মধ্যে।
অন্যদিকে বিরোধী জোটের যৌক্তিক দাবি যদি জনগণ গ্রহণ করে, তাহলে জনগণ তাঁদের পক্ষে রায় দিবে-এ বিষয়টির প্রতিও তাঁদের মনে হয়তো অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। মূলত: কোন পক্ষই জনগণের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না।
গত নির্বাচনে এদেশের জনগণ যা দেখেছে তার পূণরাবৃত্তি আর চায় না। একদিকে যেমন জ্বালাও পোড়াও দেখেছে, অন্যদিকে উন্নয়নের পাশাপাশি বিরোধীদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক চর্চার অধিকার হরণ করার বিষয়টিও শান্তিপ্রিয় জনতাকে আহত করেছে। যদিও উনিশশত নব্বই সালের তৎকালীণ স্বৈরশাসকের পতনের পর প্রতিটি নির্বাচন নিয়েই বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনের ওপর পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছে। কখনো বলা হয়েছে সুক্ষ কারচুপি, কখনো করা হয়েছে স্থুল কারচুপির অভিযোগ। তারপরও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ছিল। ছিল সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত সংসদ। যদিও এ ধারা ক্রমান্বয়ে বিরোধী দলের সাংসদদের সংসদে অনুপস্থিত থাকার রেওয়াজে পরিণত হয়। বিষয়টি জনগণের কাছে অবশ্যই প্রত্যাশিত নয়।
এবারের নির্বাচনে জনমনে এখনো একটি শঙ্কা কাজ করছে, তাহলো-জনগণ নিবির্ঘ্নে ভোট দিতে পারবো তো? তাঁদের সে শঙ্কা অবশ্যই দূর করতে হবে। আর তার দায়িত্ব যেমন সরকারকে পালন করতে হবে, তেমনি বিরোধী জোটকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণ ক্ষমতা নয়, তাঁরা শুধু সুষ্ঠ পরিবেশে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। তাঁরা চায় দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আরো এগিয়ে যাবে, গণতন্ত্র সুসংহত হবে, বিশ্ব দরবারে আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। যে স্বপ্ন নিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা-তার সুফল ভোগ করবে দেশের প্রতিটি জনগণ। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে গণতন্ত্র, জয় হবে গণতন্ত্রের।