আরিফ হাসান: পুঁজিবাজারে এক গুচ্ছ অনিয়ম সাথে পরিচালনা পর্ষদের অব্যস্থাপনায় চলছে বাংলাদেশ মনোস্ফুল পেপার মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। কোন কারন ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে লাফিয়ে বাড়ছে কোম্পানিটির শেয়ার দর। হঠাৎ কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বাড়ার বিষয়টি আতঙ্কে ফেলেছে বিনিয়োগকারীদের। কেন বাড়ছে শেয়ার দর? সেই হিসাব মেলাতে না পেরে কোম্পানির অভ্যন্তরীন বড় কোন কারসাজি হচ্ছে বলে ধারনা করছেন কোম্পানিটির বিনিয়োগকারীরা।
পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, গত ২৮ নভেম্বর ২০২১ থেকে ধারাবাহিক ভাবে বেড়েই চলেছে কোম্পানিটির শেয়ার। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৭৪.১০ টাকা। আজকে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৬.৩৫ শতাংশ বেড়ে সর্বশেষ দর দাঁড়িয়েছে ২৭২.৯০টাকায়। যা এখন পর্যন্ত কোম্পানিতে লেনদেনকৃত শেয়ারের সর্বোচ্চ দর।
এই অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কোন প্রাইস সেন্সেটিভ ইনফরমেশন স্টক এক্সচেঞ্জ কে জানায়নি মনোস্ফুল পেপার মেনুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। ডিএসইর কোম্পানি প্রফাইলেও কোম্পানি সেক্রেটারির সাথে যোগাযোগের তথ্য প্রকাশ করেনি কোম্পানিটি। কোম্পানিটির সাথে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সকল ফোন নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। যার কারনে অস্বাভাবিক এই দর বৃদ্ধির কোন কারন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া পর্যবেক্ষনে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বড় গড়মিল পরিলক্ষিত হয়েছে। কোন প্রকার কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড কে তোয়াক্কা না করেই চলছে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। পর্যবেক্ষনে জানা যায় একই ব্যাক্তি এক সাথে দুই কোম্পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন। এমনকি দুই কোম্পানির ফ্যাক্টরি ও অফিসের ঠিকানাও একই।
যদিও কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড ২০১৮ এর ৩ (১) (সি) ধারায় বলা আছে, কোন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা সিইও, কোম্পানি সেক্রেটারি, সিএফও এবং হেড অফ ইন্টার্নাল অডিট একইসময় অন্য কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে একই পদে বা অন্য কোনও পদে নিযুক্ত থাকতে পারবেন না।
পর্যবেক্ষনে জানা যায়, কোম্পানিটির কোম্পানি সেক্রেটারি মোস্তাফিজুর রহমান, সিএফও-নাইমুল ইসলাম এবং হেড অফ ইন্টার্নাল অডিট- মোঃ শাখওয়াত হোসেন একই সাথে পেপার প্রসেসিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের একই পদে দায়িত্বরত আছেন।
জানা যায়, মনোস্ফুল পেপার মেনুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং পেপার প্রসেসিং এন্ড প্যাকেজিং কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ ডিভিলপমেন্ট গ্রুপের আওতাভুক্ত ২টি কোম্পানি।
কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড ২০১৮ এর ১ এর ২ নং অনুচ্ছেদের বি এর (ii) নং ধারায় বলা আছে, কোম্পানির কোন পরিচালক বা মনোনিত পরিচালক বা কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার বা কোম্পানির কোন সহযোগি প্রতিষ্ঠান বা সহায়ক কোম্পানি, বা পারিবারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে কোন ব্যক্তি কোম্পানির ইন্ডিপেন্ডেট ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হতে পরবেন না।
কর্পোরেট গভর্ন্যান্স কোড ২০১৮ এর ১ এর ২ নং অনুচ্ছেদের বি এর (iv) নং ধারায় বলা আছে, কোম্পানির সাথে সহায়ক বা সংশ্লিষ্ট অন্য কোম্পানির সাথে আর্থিক বা অন্যথায় সম্পর্কযুক্ত কোন ব্যাক্তি কোম্পানির ইন্ডিপেন্ডেট ডিরেক্টর পদে নিযুক্ত হতে পরবেন না।
অথচ কোম্পানিটির ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর এ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া একই সাথে পেপার প্রসেসিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের ডিরেক্টর পদে নিয়োজিত আছেন।
এর আগে ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে বিভিন্ন অনিয়মের কারনে কোম্পানিটিকে মূল মার্কেট থেকে
সড়িয়ে (ওভার দ্য কাউন্টার) ওটিসি মার্কেটে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে মুনাফায় ফেরায় গত ১৩ জুন ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনা হয় এই কোম্পানিকে।
পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, বছরের পর বছর মুনাফা করলেও বিনিয়োগকারীদের ঠকিয়েছে কোম্পানিটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মনো¯পুল পেপারের কর পরবর্তি নিট মুনাফা ছিল ৩ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৪৮ টাকা; ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ০৩ কোটি ৮৬ লাখ ২২ হাজার ২৬১ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাঁচ কোটি ৭৩ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৬ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ০৬ কোটি ৭৪ লাখ ৯০ হাজার ২৯৭ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ০১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৭৬২ টাকা নিট মুনাফা করেছে কোম্পানিটি এবং ২০২০-২০২০ অর্থবছরে ১ কোটি ১৫ লাখ ১১ হাজার ৬৭৯ টাকা।
আর কোম্পানিটি লভ্যাংশ দিয়েছে ২০২১ সালে ১০ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড, ২০২০ সালে ৯ শতাংশ ক্যাশ ডিভিডেন্ড এবং ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড এবং ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড । অর্থাৎ ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত মুনাফা করলেও লভ্যাংশ দেয়নি বিনিয়োগকারীদের।
এতোসব অনিয়ম সাথে গত তিন মাস ধরে অস্বাভাবিক হারে বাজারে চড়া দামে ট্রেড হচ্ছে কোম্পানিটির শেয়ার দর। অথচ স্টক এক্সচেঞ্জ এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপি নেয়নি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় কোম্পানিটিকে বিশেষ মনিটরিং এর মাধ্যমে ব্যবস্থা না নিলে ফের হুমকির মুখে পড়তে পারে পুঁজিবাজার এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিনিয়োগকারী। তাই পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং বিনিয়োগকারিদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আরো কঠোর মনিটরিং করার পরামর্শ দিচ্ছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এদিকে আজকে আজকে কোম্পানিটি ২৬২.৩০ টাকা থেকে ২৭৫ টাকায় লেনদেন করে। যা এখন পর্যন্ত কোম্পানির সর্বোচ্চ শেয়ার দর। আজকে কোম্পানিটি ১ হাজার ৯৩৭ বারে ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৬৫ টি। যার বাজার মূল্য ৬ কোটি ৩২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গত এক বছরে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয় ৫৫ টাকা থেকে ২৬৩ টাকায়।
৫০ কোটি টাকা অনুমোদন সাপেক্ষে ১৯৮৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বাংলাদেশ মনো¯পুল পেপার ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটির বর্তমান পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ৯ কোটি ৩৮ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। এদিকে স্বল্প মূলধনী কোম্পানি হওয়ায় আগামি ডিসেম্বরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূল বাড়ানোর জন্য কোম্পানিটিকে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
কোম্পানিটির মোট শেয়ার ৯৩ লক্ষ ৮৮ হাজার ৮২৫ টি। তার মধ্যে তারমধ্যে ৫৩.৮৩ শতাংশ
উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ০.৩৫ শতাংশ এবং বাকি ৪৫.৮২ শতাংশ শেয়ার সাধারন বিনিয়োগ কারিদের হাতে।