সেলিম রেজা, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: স্বরস্বতী পুজা উপলক্ষের সিরাজগঞ্জের তাড়াশে আড়াইশো বছরের ঐতিহ্যবাহী দই মেলা। এই মেলাকে ঘিরে তাড়াশ ও সিরাজগঞ্জ শহরে নতুন সাড়া পড়েছে। তবে মেলায় নেই আগের মতো সেই জৌলুস। ক্রেতা কমে যাওয়ার সঙ্গে কমেছে দোকান ও বিক্রেতা।
এটি মূলত শ্রী পঞ্চমী মেলা হলেও এলাকাবাসীর মুখে মুখে দইমেলা নামেই পরিচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা উপলক্ষে দিনব্যাপী দইয়ের মেলাটি আড়াইশো বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে স্থানীয়রা।
বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারী) সকাল থেকে তাড়াশ বাজার ও সিরাজগঞ্জ শহরের মুজিব সড়কে এ দইমেলা চলছে।
স্থানীয়রা জানান, মেলা উপলক্ষে বুধবার (২৪ জানুয়ারী) বিকেল থেকে সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার নামিদামি ঘোষদের দই আসার মধ্য দিয়ে সিরাজগঞ্জ শহর ও তাড়াশে ঐতিহ্যবাহী দইয়ের মেলা শুরু হয়েছে। দিনব্যাপী মেলায় দইসহ রসনা বিলাসী খাবার ঝুরি মুড়ি, মুড়কি, চিড়া, মোয়া, বাতাসা, কদমা, খেজুরের গুড়সহ বাহারি সব খাবার বেচাকেনা হচ্ছে। এ দই মেলা নিয়ে রয়েছে নানা গল্পকাহিনী। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা এই মেলা আগামী দিনে আরও প্রসারিত হবে এমনটাই প্রত্যাশা দই প্রেমীদের।
জানা যায়, চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশের তৎকালীন জমিদার পরম বৈঞ্চব বনোয়ারী লাল রায় বাহাদুর প্রথম দই মেলার প্রচলন করেছিলেন। এলাকায় জনশ্রতি আছে জমিদার রাজা রায় বাহাদুর নিজেও দই ও মিষ্টান্ন পছন্দ করতেন। তাই জমিদার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়নে এ অঞ্চলে ঘোষদের তৈরি দই পরিবেশন করতেন। আর সে থেকেই জমিদার বাড়ির সম্মুখে রশিক রায় মন্দিরের মাঠে স্বরস্বতী পূজা উপলক্ষে দিনব্যাপী দই মেলার প্রচলন শুরু করেন। সে থেকে প্রতি বছর শীত মৌসুমের মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার দিন শ্রী পঞ্চমী তিথিতে দই মেলার শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তাড়াশ বাজারের পাশ্বাপাশি সিরাজগঞ্জ শহরেও বসে দইয়ের মেলা।
মেলায় দই নিয়ে আসা জেলার এনায়েতপুরের রনি মিষ্টান্ন ভান্ডারের রঞ্জিত ঘোষ বলেন, আজ ১৫ মণ দই নিয়ে এসেছি। দইয়ের চাহিদা থাকায় দুপুরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তবে দুধের দাম, জ্বালানি, শ্রমিক খরচ, দই পাত্রের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে।
রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা থেকে আসা দই বিক্রেতা দিলীপ ঘোষ জানান, বাপ-দাদার আমল থেকেই তিনি দই নিয়ে মেলায় আসেন। প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ মণ দই বিক্রি করেন তিনি। লাল কুমার (৫২) নামে একজন ক্রেতা সন্তান নিয়ে মেলায় এসেছেন দই কিনতে। তিনি বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই এই মেলা দেখে আসছি।
দই কিনতে আসা অমিত্র সাহা বলেন, প্রতি বছর সকালে এই মেলা থেকে দই কিনি। স্বরস্বতি পূজা উপলক্ষে বাড়িতে অনেক অতিথি এসেছে। তাদের আপ্যায়নের জন্য দই কিনছি। আরেক ক্রেতা বলেন, বোন ও জামাইসহ অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছে। এখানকার দই খুব সুস্বাদু। প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ কেজি দই কিনে থাকি। তবে এবার একটু দাম বেশি। তার পরেও ৫ কেজি দই কিনেছি।
তাড়াশ উপজেলা সনাতন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সনাতন কুমার দাস বলেন, ঐতিহ্য মেনে এখনো তাড়াশে দইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে মেলা হলেও আগের মতো সেই জৌলুস আর নেই। অল্প কিছু দোকান বসেছে। মেলা সুষ্ঠু পরিবেশে সম্পন্ন করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সন্তোষ কুমার কানু বলেন, শীত মৌসুমে মাঘ মাসে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এ দই মেলা বসে থাকে। সিরাজগঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলায় এই মেলা প্রায় আড়াইশো বছরের ঐতিহ্য।
তিনি আরও বলেন, আগে মেলায় মানুষের ভিড় বেশি থাকায় ঢোকায় যেত না। কিন্তু এবার তাড়াশ ও শহরে মাত্র ১৫-১৮টি দোকান বসেছে। মানুষের মধ্যেও নেই সেই আগ্রহ। এখন আর মেলা উপলক্ষে নেই সাজ সাজ ভাব, আগের মতো আর আসে না জামাই বা আত্মীয়-স্বজনরা।