বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া এবং দেশীয় নানা কারণে সম্প্রতি দেশে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি, দেশে সরবরাহকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের (বিটিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এ তসলিম।
প্রশ্ন: বিগত কয়েক বছর আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেশ কম ছিল। চলতি বছরের শুরুতে জ্বালানি তেলের দামও তলানিতে নেমেছিল। এখন আবার কিছুটা বেড়েছে। সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক পণ্যবাজার কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে?
এম এ তসলিম: না। পণ্যের দাম নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো কিন্তু তা বলছে না। এ বছর পণ্যের বাজারদর বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না।
প্রশ্ন: বিশ্ববাজারে চিনির দাম বেশ বেড়েছে। আমাদের দেশেও অনেক বেড়েছে।
এম এ তসলিম: চিনির আন্তর্জাতিক বাজারদর টনপ্রতি ৫৪০ ডলার হলে তা কেজিতে ৪৩ টাকার মতো দাঁড়ায়। এটাকে খুব চড়া দর বলা যাবে না। প্রশ্ন হলো, চিনির ওপর এখন মোট করভার কত?
প্রশ্ন: চিনির ট্যারিফ বা শুল্কায়ন মূল্য টনপ্রতি ৩৫০ ডলার ধরে এর ওপর ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, টনপ্রতি ২ হাজার টাকা সুনির্দিষ্ট শুল্ক ও ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আছে। চিনির ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। এটার যৌক্তিকতা কতটুকু?
এম এ তসলিম: এটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বছরের পর বছর ধরে তাদের নানাভাবে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোর কোনো উন্নতি হয়েছে তা কিন্তু নয়। অতএব, এটা প্রমাণিত যে তাদের সহায়তা দিয়ে টাকা নষ্ট করা ছাড়া কোনো লাভ হয় না। এর চেয়ে ভালো, চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীন যত জনবল আছে, তাদের ৫-১০ বছরের বেতন দিয়ে কোম্পানিগুলো বন্ধ করে দেওয়া। কারণ সরকারের বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আর তারা মোট চাহিদার ৮ শতাংশ উৎপাদন করে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কখনোই পারবে না। বেসরকারিভাবেও অনেক খাতকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। যেমন বিস্কুট, ব্যাটারি, বস্ত্র খাত। সুরক্ষা নিয়ে তারা জনগণের কাছ থেকে উচ্চমূল্য আদায় করে। এর কোনো মানে হয় না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে আখের চাষ বাড়িয়ে কি চিনি উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে?
এম এ তসলিম: কোনো সুযোগ নেই। আপনি আখ চাষ করবেন কোথায়? আখ চাষ করতে হলে তো অন্য ফসলের জমি কমাতে হবে। সুতরাং, আমাদের দেখতে হবে কোন ফসলের চাষ আমাদের জন্য লাভজনক। কোন ফসলটি বিদেশ থেকে কম দরে আমদানি করা যায়। চিনির দাম যেহেতু অনেক বেশি ওঠানামা করে, সেহেতু এটির উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ। চিনিতে যাওয়ার আমাদের দরকার কী?
প্রশ্ন: মোটা চালের দাম সম্প্রতি বেশ বেড়ে গেছে। কেজিপ্রতি ২৮ থেকে ৩০ টাকার চাল ৪০ টাকায় উঠেছে।
এম এ তসলিম: হ্যাঁ, প্রচুর বেড়ে গেছে। ২৩ থেকে এটা ৩৮-এ উঠেছে। এটা কেন বেড়েছে তা বাজার বিশ্লেষণ ছাড়া বলা কঠিন। তবে এটা নিশ্চিত যে মোটা চালের সরবরাহে টান পড়েছে। এ ছাড়া দাম বাড়ার কারণ নেই। তবে বছরের এই সময়টায় দাম কিছুটা বেড়ে থাকে।
প্রশ্ন: ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর সরকারই মোটা চাল কিনে নিচ্ছে। পাশাপাশি মোটা ধানের আবাদ কম হয়েছে।
এম এ তসলিম: এটা হলে এক দিক থেকে ভালো লক্ষণ। বোঝা যাচ্ছে, কৃষকেরা বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেন। তাঁরা বুঝতে পেরেছেন মোটা ধানে তাঁদের বিশেষ কোনো লাভ নেই। এ কারণে তাঁরা অন্যান্য ধান আবাদ করছেন। তবে ব্যাপার হলো, মোটা চালের দাম বেড়েছে। এমনকি মোটা ও মাঝারি চালের দামের পার্থক্য নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন: মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে দেখা যাবে যে গত কয়েক বছরে চালের প্রকৃত মূল্য কমেছে। এবার তা বাড়ল। এতে ভবিষ্যতে কৃষকের ধান চাষে আগ্রহ বাড়বে কি?
এম এ তসলিম: কিছুটা বাড়বে অবশ্যই। প্রকৃত মূল্য বাড়লে কৃষকদের মধ্যে যাঁরা ধান ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা আবার ফিরে আসবেন। এ দেশের কৃষকেরা কিন্তু বাজারের প্রতি বেশ সংবেদনশীল। পণ্যের দামের ওঠানামা ভালোভাবেই নজরে রাখেন। সে অনুযায়ী চাষ করেন। এখন কিন্তু অনেক কৃষক ফল, সবজিসহ বিভিন্ন লাভজনক ফসল চাষ করছেন। এটা এক দিক থেকে ভালো জিনিস। আমরা চাল বিদেশ থেকে আরও কম দামে আমদানি করতে পারলে অসুবিধা কী? আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এখন অনেক পড়ে গেছে। আমাদের জন্য এটা ভালো যে কৃষকেরা উচ্চমূল্যের ফসল চাষ করবেন। সস্তার ফসল বিদেশ থেকে আমদানি করা হবে।
প্রশ্ন: এবারের বাজেটে চালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এম এ তসলিম: এত প্রণোদনা দেওয়া উচিত নয়। ভারতের কৃষকদের চেয়ে আমরা কম সক্ষম (ইফিসিয়েন্ট) হব কেন?
প্রশ্ন: বাংলাদেশে ভোজ্যতেল, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের হাতে। অনেক প্রতিষ্ঠান লোকসান দিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রতিযোগিতার কোনো ঘাটতি কি তৈরি হয়?
এম এ তসলিম: যারা টিকতে পারেনি তারা কিন্তু প্রতিযোগিতার কারণেই বন্ধ হয়ে গেছে। এ দেশের বড় মিলগুলো চাহিদার বড় অংশ সরবরাহ করতে পারে। উৎপাদন বাড়লে তাদের খরচও কমে। ফলে ওদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ছোটরা টিকবে না। বড়দের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তারা যাতে কলিউশন (গোপনে জোটবদ্ধ হয়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ) করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। এটার জন্য আসলে দরকার ছিল প্রতিযোগিতা নীতিমালা। কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়ন করতে যে ধরনের মেধা দরকার, তা মনে হয় বাংলাদেশে খুব একটা গড়ে ওঠেনি। আর তা কলিউশন করেছে কি না, তা ধরা খুব কঠিন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও খুব বেশি লোককে ধরা যায়নি। অন্যদিকে কোম্পানির সংখ্যা দিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা যায় না। যেখানে দুজন উৎপাদক থাকেন, সেখানেও তীব্র প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। আবার যেখানে ২০ জন উৎপাদক আছেন, সেখানেও কলিউশন থাকতে পারে। যেমন এয়ারবাস আর বোয়িংয়ের মধ্যে কখনো কলিউশন হয়নি। দেখতে হবে, যাতে কোনো রকম ‘কলিউসিভ অলিগোপলি’ গড়ে না ওঠে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কীভাবে তেল-চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে?
এম এ তসলিম: এ ক্ষেত্রে ভালো উপায় হতে পারে আমদানি উন্মুক্ত করে দেওয়া। পরিশোধিত চিনি বা ভোজ্যতেলে শুল্কহার সমান করে দিলে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
প্রশ্ন: তখন তো দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা না দেওয়ার অভিযোগ আসবে।
এম এ তসলিম: দেশীয় কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকতে না পারলে তাদের সুরক্ষা দিয়ে লাভ নেই। আর এর একটা ব্যয় তো আছে। যে জিনিস আমি ২০ টাকায় পেতে পারি, সেটা ওরা ৩০ টাকা নিচ্ছে। আমার তো ১০ টাকা হারাতে হচ্ছে।
প্রশ্ন: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কমেছে। সরকার দাম সামান্য কমিয়েছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক?
এম এ তসলিম: জ্বালানি তেলের কোম্পানিগুলো অদক্ষ। এটা সরকারই বলে। একসময় তারা লোকসান দিয়েছে। এখন প্রচুর লাভ করছে। দাম না কমিয়ে সরকার তাদের আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে আড়াই গুণ বেশি দামে তেল বিক্রির সুযোগ দিচ্ছে। আসলে সরকার জ্বালানি তেলকে রাজস্ব আদায়ের একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে, আর কিছু না। যেহেতু সরকারের রাজস্ব দরকার। সূত্র: প্রথম আলো