সারাদেশের বন্যা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উজান থেকে নদীতে নেমে আসা পানি আর অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে সারা দেশে বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সকল জেলায় চিকিৎসকদের বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যে কোনো কোনো জেলায় কাজও শুরু করেছে। অন্যদিকে, এবার দেশের নিম্ন-মধ্যাঞ্চলে বন্যার বিস্তার ঘটেছে আর উত্তরের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত এবং মধ্যাঞ্চলে অবনতি হয়েছে। প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও গো-খাদ্যের সংকটের পাশাপশি পানিবাহিত নানারোগ দেখা দিয়েছে।
এতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বানভাসী লাখ লাখ মানুষ। সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ দুর্গতদের। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে সারা দেশের বন্যা পরিস্থিতি। দিন দিন দুর্ভোগ বাড়ছে পানিবন্দি মানুষের। বন্যায় পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলা সদর, ইসলামপুর, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, বকশীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৪৪টি ইউনিয়নে পানিবন্দি রয়েছেন প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। পানি উঠে পড়ায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জেলার ৩০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার ও গো খাদ্যের অভাবের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে পানি বাহিত নানা রোগ। নদ-নদীর পানি সামান্য কমলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে কুড়িগ্রামে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারি পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে ধরলার পানি কমে সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ২ শতাধিক চর ও দ্বীপচরে বানভাসী মানুষজন ১০ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছেন। জেলার ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৫ শতাধিক গ্রামের প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বন্যার্তদের সহায়তায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০০ মেট্রিকটন চাল ও ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন দুর্গত এলাকার মানুষেরা। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ, রংপুর, সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
জানা গেছে, গত ৮ জুলাই থেকে ভারতের বিভিন্ন অংশে পানি কমাতে তিস্তায় গজলডোবা ব্যারেজের গেট খোলা শুরু করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এর পরের তিন দিন ক্রমান্বয়ে ৫৪টি গেটের সব কটিই খুলে দেয়। এতে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ভেঙে যায় বিভিন্ন স্থানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদীর তীর রক্ষা বাঁধ। দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। অবশ্য গত বছরের মতো এবার এখনও ভারত ফারাক্কার গেট খুলে দেয়নি। ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের মতোই এবার বাংলাদেশেও মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে এবং সারাদেশেই এখনও প্রায় প্রতিদিনই ভারী বর্ষণ হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে প্রায় সবগুলো বড় নদীর পানিই বইছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। গত ৬ দিন থেকে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ১৪ জুলাই সকাল থেকে পদ্মা নদীর পানিও বইছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে। পানি বাড়ছে ব্রহ্মপুত্র নদীতেও। এসব কারণে সারা দেশেই বন্যার আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্তা ব্যক্তিরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঈদের আগেই আমাদের কাছে ভয়ানক বন্যার বার্তা দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেই খবর বাইরে প্রকাশ করা হয়নি, তবে আমরা ভেতরে ভেতরে ঠিকই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। ৬৪ জেলাই প্লাবিত হতে পারে ধরে নিয়েই আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। তিনি আরো জানান, দেশের সবগুলো জেলাতে বন্যাকলীন চিকিৎসা প্রদানের জন্য চিকিৎসকদের টিম গঠন করা হয়েছে। তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে যাতে যেকোনো ধরনের দুর্যোগ দ্রুত সামাল দেওয়া যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অন্যান্য কাজের সঙ্গে প্রতিদিন বন্যাকালীন কাজের প্রস্তুতির নিয়মিত খোঁজ রাখছেন। এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলায় কর্মরত একজন চিকিৎসক বলেন, ঈদের আগেই সিরাজগঞ্জের সিভিল সার্জন সদর উপজেলার জন্য তিনটি টিম গঠন করে দিয়েছেন। টিমের সকল সদস্যদের তখনই জরুরি বার্তা দেওয়া হয়েছে। অনেককেই ঈদে ছুটি দেওয়া হয়নি। আবার যাদেরকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল তাদেরকেও যেকোনো মুহূর্তে কর্মস্থলে ফিরতে হবে এমন বার্তা দেয়া হয়েছিল।
বন্যার কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১২ জুলাই গাইবান্ধা জেলার ১৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো বানভাসী মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়। একই দিন জামালপুর জেলার ১৩৩টি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়। এভাবে প্রায় সারাদেশেই অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, কোথাও ঘোষণা দেয়া হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারণে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। এতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। হুমকির মুখে পড়েছে বিভিন্ন শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই সিরাজগঞ্জ জেলায় যমুনা নদীর তীরে বাহুকা নামক স্থানে নদীর তীরে ভাঙন দেখা দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে তাৎক্ষণিকভাবে সেনাবাহিনীকে কাজে নামানো হয়। গত শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনীর ১১ পদাতিক ডিভিশনের রিভার কোরের মেজর সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সেনা সদস্যদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদার নিয়োগ করে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সেখানে ত্রাণ সহায়তার আওতায় এসেছে মাত্র এক হাজার পরিবার। কিন্তু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ২০ হাজারের ওপর। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সেখানে ৩০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল এবং ২০০ করে টাকা দেয়া হয়েছে। অথচ কাজীপুরে পানিবন্দি রয়েছে অন্তত দুই হাজার পরিবার।
বন্যার কারণে হাওরাঞ্চলের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেও দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট। গত দশ দিনের বেশি সময় ধরে পানিবন্দি থাকায় বিশেষ করে চরাঞ্চলগুলোতে খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রালয়ের পক্ষ থেকে ত্রাণের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে বলা হলেও বাস্তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এখন থেকে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বানভাসী মানুষের দুর্দশা বাড়বে, যার নেতিবাচক ্প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় জীবনে।