সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : নিজ পদকে হাতিয়ার বানিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে লুটপাটের আখড়া বানিয়েছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জাহিদুর রহমান। নিয়মবহির্ভুতভাবে বাগিয়েছেন সাতক্ষীরা সিটি কলেজে স্ত্রীর চাকরি। একই স্টেশনে ৭ বছর থাকার সুবাদে লুটপাট করেছেন ১০ কোটি টাকা। তার দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে শিক্ষকরা একাধিকবার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হলেও এক অদৃশ্য খুটির জোরে তিনি স্বপদে বহাল আছেন সাতক্ষীরা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা সিটি কলেজে শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগে অনিয়মের জেরে দুদকের মামলায় বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন সাবেক অধ্যক্ষ আবু সাইদসহ ৫ জন শিক্ষক। নাশকতার একাধিক মামলায় জেলহাজতে যাওয়া আসামী জাহাঙ্গীর আলম ২০১৫ সালে দর্শন বিভাগে অনার্স শাখায় চতুর্থ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।
পরবর্তীতে রেজুলেশন জালিয়াতি করে তিনি ডিগ্রি স্তরে ২০১৭ সালে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে এমপিওভুক্ত হন। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলমসহ ২১ জন অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্বেও ৬৩ লাখ টাকার বিনিময়ে তাদের ফাইল ছাড় করান শিক্ষা অফিসার জাহিদুর রহমান। একই সময়ে প্রভাষক থেকে পদোন্নতি পাওয়া ১৫ জন সহকারি অধ্যাপকের কাছ থেকে তিনি ঘুষ নিয়েছিলেন সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা।
এমপিওভুক্তির পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সিটি কলেজে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা শেষে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর চুড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চুড়ান্ত প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীর আলমসহ ২১ জন শিক্ষকের এমপিও বিধিসম্মত নয় বলে উল্লেখ করে তাদের বেতন-ভাতা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ২০২১ সালে ১৫ জুন দুদকের নির্দেশে মাউশি,খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক প্রফেসর হারুণ-অর-রশিদ সিটি কলেজের যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান তার দুর্নীতির দায় এড়াতে পারেননা বলে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। অর্থ আর ক্ষমতার জোরে অবৈধভাবে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে গার্হস্থ অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি বাগিয়ে নেন জাহিদুর রহমানের স্ত্রী জেসমিন নাহার।
২০০৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ আইন কার্যকর হওয়ার আগের দিন তড়িঘড়ি করে একই দিনে স্ত্রীর নিয়োগ বোর্ড গঠন ও যোগদান করার নজির স্থাপিত হয়েছে জাহিদের কলা কৌশলে। যেটি বিধিসম্মত নয় বলে শিক্ষা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
সাতক্ষীরা সিটি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বিধান চন্দ্র দাশ জানান, আমাকে বঞ্চিত করে বিধি-বহির্ভূতভাবে রুনা লায়লা নামের একজন শিক্ষককে নিয়োগ ও এমপিও বন্ধের জন্য ২০১৭ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি আমি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বরাবর আবেদন করি। তিনি আবেদনটি গ্রহণ না করে আমাকে রীতিমতো অপমান করেছিলেন। সরকারি সেবা পেতে জাহিদুর রহমানকে পদে পদে দিতে হয় ঘুষ ফাইল অনুযায়ী দিতে হয় টাকা। ঘুষ ছাড়া কোন ফাইল সই করেননা তিনি।
সরকারের দেওয়া বিনামুল্যের বই পেতে তাকে দিতে হয় স্কুল প্রতি ৪ থেকে ৫শ’ টাকা। সদর উপজেলার ১শ’ ০২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো পাঠ্যপুস্তকের পরিবহন ব্যয় বাবদ সরকারি ৯৮ হাজার টাকা পকেটস্থ করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের সময় মাউশির প্রতিনিধি হিসেবে নুন্যতম ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত বাধ্যতামুলকভাবে তাকে ঘুষ দিতে হয় তাকে। এ ছাড়া নতুন এমপিওকরণের জন্য তাকে প্রতিজনের জন্য ঘুষ দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। শিক্ষক থেকে শুরু করে অফিসের কর্মচারীদের অহরহ অপমান করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুন্ধে।
প্রধান শিক্ষকের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে সম্প্রতি যশোর শিক্ষা বোর্ড থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার হয়েছেন ধুলিহর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অফিস সহায়ক রবিউল ইসলাম মন্টু।
তিনি জানান, রিপোর্ট আমার পক্ষে দেওয়ার জন্য তার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন জাহিদুর রহমান।
এ ছাড়া কুখরালী আহমাদিয়া দাখিল মাদ্রাসা, ঘোনা মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুলে টাকার বিনিময়ে রাতের আধারে পাতানো পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জাহিদুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সাবেক সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি নির্বাচনে ফেল করায় একটা গ্রুপ আমাকে নিয়ে এসব কুৎসা রটাচ্ছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ জানান, একই স্টেশনে ৭ বছর থাকার নিয়ম নেই। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের মত কর্মকর্তাদের দায় মাউশি নেবেনা।
সাতক্ষীরা সদর-২ আসনের নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য আশরাফুজ্জামান আশু জানান,আমার সময়ে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করব।