আতিকুর রহমান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: মৃত মাদ্রাসা সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে একটি মাদ্রাসায় ১২জন শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ দিয়ে প্রায় কোটি টাকার বানিজ্য করা হয়েছে।
এ ঘটনায় মাদ্রাসা সুপার মোঃ ইয়ারুল হকের বিরুদ্ধে আমলী আদালতে একাধিক মামলাও হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা করেছেন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ও জমিদাতা মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে কনক মন্ডল। গত ২৩ নভেম্বর তিনি হরিণাকুন্ডু আমলী আদালতে মামলাটি করেন।
আদালতের বিজ্ঞ বিচারক জেসমিন নাহার মামলাটি আমলে নিয়ে ঝিনাইদহ সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপারকে তদন্ত করে আগামী ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে মৃত মাদ্রাসা সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে নিয়োগ জালিয়াতি নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। যে কোন সময় অপ্রীতিকর ঘটনার আশংকা করছে এলাকাবাসি। আদালতে দায়ের করা মামলা সুত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে হরিণাকুন্ডু উপজেলার পারফলসি গ্রামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) না হওয়ায় মাদ্রাসাটি কোন রকম খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছিল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল না। স্টাফ প্যাটার্ন অনুযায়ী মাদ্রাসাটিতে ছিল না কোন পুর্ণাঙ্গ শিক্ষক নিয়োগ। প্রয়াত সভাপতি খলিলুর রহমান মাত্র ৬ জন শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে যান। তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১১ সালে মারা যান। এমপিও না হওয়ার কারণে সুপারসহ অন্যান্য শিক্ষক মাদ্রাসা ছেড়ে চলে যান। ২০১২ সালে হরিণাকুন্ডু উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান টুটুলকে ভারপ্রাপ্ত সুপার হিসেবে নিয়োগ দিলে তিনিও কয়েক মাস দায়িত্ব পালন করে অন্যত্র চলে যান। পারফলসি দাখিল মাদ্রাসাটিতে বৈধ কোন সুপার ছিল না। ২০২২ সালের ৬ জুলাই মাদ্রাসা এমপিও ভুক্ত হলে বর্তমান মাদ্রাসা সুপার ইয়ারুল হক হরিণাকুন্ডু সিদ্দিকীয়া আলিম মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে হঠাৎ আর্বিভুত হন সুপার হিসেবে। তিনিসহ ১২ জন শিক্ষক দাবী করে বসেন প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি খলিলুর রহমান তাদের নিয়োগ দিয়ে গেছেন। এ নিয়ে এলাকায় শোরগোল শুরু হয়। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে রাতারাতি মৃতপ্রায় মাদ্রাসায় শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এলাকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।
সরজমিন মাদ্রাসায় সদ্য নিয়োগ পাওয়া জুনিয়র মৌলভী শিক্ষক রাফেজা খাতুন, সহকারী মৌলভী শিক্ষক বাবলুর রশিদ ও জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কথা হয়। তারা নিজেদের নিয়োগ নিয়ে কোন তথ্য প্রমান দেখাতে পারেনি। কোন পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় প্রশ্ন করা হলে তারা আধুনালুপ্ত ‘দৈনিক আজকের কাগজ’ পত্রিকার কথা বলেন। বন্ধ পত্রিকায় কি ভাবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলো ? জিজ্ঞাসা করা হলে বিষয়টি মাদ্রাসা সুপার ইয়ারুল হক জানেন বলে তারা জানান। এছাড়া নিয়োগ বোর্ড কোথায় হয়েছিল বা নিয়োগ বোর্ডে সরকারী কোন কোন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন কিনা তাও তারা বলতে পারেননি।
মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দপ্তরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মনজের আলী। তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল এই ১০ বছর পর্যন্ত বর্তমান সুপার ইয়ারুল হক ছিল না। এমপিও ভুক্ত হওয়ার পর তিনি রাতারাতি উড়ে এসে জুড়ে বসেন এবং প্রায় ৮০ লাখ টাকার নিয়োগ বানিজ্য করেন। ১৬ বছর ধরে মাদ্রাসাটিতে চাকরী করছেন বিপ্লব হোসাইন নামে এক শিক্ষক। এমপিও ভুক্তির পর তিনি নিয়োগ পেতে চারজন সাক্ষির উপস্থিতিতে মাদ্রাসা সুপার ইয়ারুল হকের কাছে ১০ লাখ টাকা প্রদান করেন। কিন্তু তাকে চাকরী প্রদান করা হয়নি। টাকা নিয়েও চাকরী না দেয়ার কারণে তিনি ঝিনাইদহের বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। মামলার আরজিতে সুপার ইয়ারুল হককে একজন মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ, বিশ্বাস ভঙ্গকারী ও প্রতারক হিসেবে দাবী করা হয়।
মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতির ছেলে ও আরেক মামলার বাদী কনক মন্ডল জানান, সুপার ইয়ারুল হক দাবী করছেন তিনি ২০০৪ সালে যোগদান করেছেন। তিনি যে কত বড় প্রতারক ও জালিয়াতি চক্রের হোতা তা শিক্ষার্থীদের রেজিষ্ট্রেশন কার্ডের স্বাক্ষর যাচাই করলে বোঝা যাবে। ২০০৭-২০০৮ শিক্ষাবর্ষে পারফরসি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন আকরাম হোসেন নামে এক শিক্ষার্থী। তার রেজিষ্ট্রেশন কার্ডে মাদ্রাসা প্রধান হিসেবে স্বাক্ষর রয়েছে তৎকালীন সুপার মোস্তাফিজুর রহমান টুটুল। বর্তমান সুপার যদি ২০০৪ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করতেন তবে তো তার স্বাক্ষর থাকতো।
এ বিষয়ে মাদ্রাসা সুপার সুপার ইয়ারুল হক জানান, তাদের নিয়োগ দিয়ে গেছেন সাবেক সভাপতি খলিলুর রহমান। কোথায় কবে নিয়োগ বোর্ড বসেছিল তা তার মনে নেই বলে জানান।
বিষয়টি নিয়ে হরিণাকুন্ডু উপজেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল বারী জানান, নিয়োগ নিয়ে মামলা হয়েছে। বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করে যে রিপোর্ট প্রদান করবে তার ভিত্তিতে ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।
হরিণাকুন্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুস্মিতা সাহা জানান, নিয়োগের বিষয়ে কোন অভিযোগ থাকলে আমাকে লিখিত ভাবে জানালে আমি মাদ্রাসা বোর্ডকে অবহিত করতে পারতাম। তিনি বলেন, বিষয়টি যেহেতু আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, সেহেতু এখন সেখানেই ফয়সালা হবে।