কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক: প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়েছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’।
প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে এ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শুরু হয়।
অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীরা এই মর্মে অঙ্গীকার ও ঘোষণা করছি যে-
১। জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
২। যেহেতু জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক, তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সেহেতু রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ গ্রহণ করেছি বিধায় এ সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব।
৩। জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না, উপরন্তু উক্ত সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব।
৪। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।
৫। গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
৬। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
৭। জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ এর ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো ধরনের কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন- কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাংবাদিক মনির হায়দার।
ঘড়ির কাঁটার ঠিক ৫টা ৫ মিনিটে প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর দুইজন করে প্রতিনিধি ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি ও সদস্যরা স্বাক্ষর করেন। এরপর ৫টা ৭ মিনিটে সনদে স্বাক্ষরের করেন প্রধান উপদেষ্টা। স্বাক্ষরের পরে তারা সনদ উঁচিয়ে ধরে দেখান।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ২৫টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এরা হলেন- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ; বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী-র কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের ও সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার; লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)-এর মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নেয়ামূল বশির; খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের; রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম ও মিডিয়া সমন্বয়ক সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন; আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ভূঁইয়া মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ; নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার; জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)-এর চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ও মহাসচিব মোমিনুল আমিন; বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা ইউসুফ আশরাফ ও মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ; গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল; জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)-এর সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও সিনিয়র সহ-সভাপতি মিসেস তানিয়া রব; গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন; বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ও রাজনৈতিক পরিষদ সদস্য বহ্নিশিখা জামালী; জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)-এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান; ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান; গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মিজানুর রহমান; জাকের পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া ও গাজীপুর জেলা ছাত্রফ্রন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হাসান শেখ; জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সমন্বয়ক আমিনুল হক টিপু বিশ্বাস ও সদস্য মঞ্জুরুল আরেফিন লিটু বিশ্বাস; বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সিনিয়র নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল মাজেদ আতহারী ও মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার; বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব খন্দকার মিরাজুল ইসলাম; ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ রফিকুল ইসলাম (বাবলু) ও মহাসচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ (সেলিম); জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী ও মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী; ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল কাদের ও মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী এবং আমজনতার দলের সভাপতি কর্নেল মিয়া মশিউজ্জামান (অব.) ও সাধারণ সম্পাদক মো. তারেক রহমান।
এছাড়াও শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এবং শহীদ তাহির জামান প্রিয়র মা শামসী আরা বেগম জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
আজকের এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দ, সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ, আইনজীবী, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ও শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিশেষ অতিথিবৃন্দ ।
শুরুতেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সূচনা বক্তব্য দেন কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। এরপর সনদ স্বাক্ষর শেষে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা।
এরপর গত ষোল বছরের দুঃশাসন, দুর্নীতি, গুম, খুন, শাপলা চত্বরের ও পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও জুলাই আগস্ট গণ অভ্যুত্থান , জুলাই সনদ এর ওপর সাত মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। এর নাম ‘ভবিষ্যতের পথরেখা’।
ডকুমেন্টারি প্রদর্শনের পর জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা। পরে প্রধান উপদেষ্টা তাদের সঙ্গে মঞ্চের সামনে একটি ফটোসেশনে অংশগ্রহণ করেন।


