স্পোর্টস ডেস্ক: অবশেষে দীর্ঘ ২৭ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আইসিসির বড় কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপার জিতলো দক্ষিণ আফ্রিকা। লন্ডনের বিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতে নিল প্রোটিয়ারা।
চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল মাত্র ৬৯ রান, হাতে ছিল ৮ উইকেট। যদিও ম্যাচের নিয়ন্ত্রণে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, তবে অতীত ইতিহাসের কারণেই অনেকে শঙ্কিত ছিলেন বিশেষ করে ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বিভীষিকাময় ফাইনালের পর। সেদিন বার্বাডোজে ভারতের বিপক্ষে ৩০ বলে ৩০ রান তুলতে ব্যর্থ হয়ে শেষ মুহূর্তে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ ঘটে। কিন্তু লর্ডসে এমন হতাশার পুনরাবৃত্তি হতে দেননি অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। দিনের শুরুতেই টেম্বা বাভুমা ফিরে গেলেও দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিতে (১৩৬ রান) দলের জয় নিশ্চিত করেন তিনি। বাভুমার হাফ সেঞ্চুরি ও মার্করামের শতকে ভর করে টেস্টের নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়া ছিল প্রোটিয়াদের হাতে।
এর আগে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২১২ রান তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। বিপরীতে মোটে ১৩৮ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল প্রোটিয়ারা। দ্বিতীয় ইনিংসেও ২০৭ রান তুলেছিল অসিরা। এতে তাদের লিড দাঁড়িয়েছিল ২৮১ রানে।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার এই জয় দেখে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, আসলে ছিল তার বিপরীত। লর্ডসে পেসারদের দাপটে যেখানে দাঁড়াতেই পারছিলেন না ব্যাটাররা, সেখানে এই রানকে ধরা হচ্ছিল এভারেস্ট সমান উঁচু। প্রেডিকশন, জয়ের পারসেন্টেজ, ম্যাচের পরিস্থিতি; সব কিছুই ছিল অসিদের পক্ষে। সেসবকে ভুল প্রমাণ করে সেই এভারেস্ট জয় করল প্রোটিয়ারা।
আইসিসির বড় কোনও টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার নাম শুনলেই ভক্ত-সমর্থকদের মনে ‘চোকার’ শব্দটা চলে আসে। শিরোপার খুব কাছে থেকে ফিরে আসা দল তারা। সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনালে গিয়ে হারার রেকর্ড আছে বহুবার। ১৯৯৮ সালে মিনি বিশ্বকাপের পর আর কোনও ট্রফি জিততে পারেনি প্রোটিয়ারা। সেই ঐতিহাসিক দিনটিতে তারা জিতেছিল নকআউট ট্রফি (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস ট্রফি)। এরপর বহুবার সেমিফাইনাল কিংবা ফাইনাল খেলেও হতাশা ছাড়া কিছু জোটেনি।
সর্বশেষ আইসিসির বড় তিনটি টুর্নামেন্টের মধ্যে ২০২৪ সালে ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে, ২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিতে নিউজিল্যোন্ডের বিপক্ষেও হারের স্বাদ পেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
প্রোটিয়ারা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ২০২৩-২৫ চক্রের ফাইনালে এসেছে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থেকে।
শেষ পর্যন্ত ‘চোকার্স’ তকমা ঘোচাল দক্ষিণ আফ্রিকা। ইতিহাসের পাতায় এবার তাদের নাম উঠে গেল বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে।
এর আগে ফাইনালের প্রথম দিনে টস জিতে বোলিং নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ম্যাচের শেষদিকে পিচ ব্যাটিং সহায়ক হয়ে যাওয়া মিচাল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স এবং জশ হ্যাজেলউডদের মতো বোলাররা কোনো সুইং পাচ্ছিলেন না। অভিজ্ঞ নাথান লায়ন বল স্পিন করাতে পারলেও ভাঙতে পারেননি মোকামদের প্রতিরোধ। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ২৮১ রান ডিফেন্ড করতে পারেনি অজিরা। চতুর্থ ইনিংসে ২৮২ রান তাড়া করে ৫ উইকেটের জয় ছিনিয়ে নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই জয়ের সর্বাধিনায়ক এইডেন মার্করাম। এই ওপেনারের অসাধারণ ব্যাটিংয়েই জয় পেয়েছে প্রোটিয়ারা। স্টার্ক-কামিন্সদের পেস গোলার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাট করেছেন তিনি। উপহার দিয়েছেন ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরি। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে যা এক বিস্ময়কর। ফাইনালে এটিই একমাত্র সেঞ্চুরি। সেঞ্চুরি তো দুরে থাক, চার ইনিংস মিলিয়ে হাফসেঞ্চুরিই হয়েছে মোটে চারটি। সেখানে মার্করামের এই ইনিংসকে বিস্ময়কর বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত ২০৭ বলে ১৩৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ১৪টি চারে সাজানো ছিল তার ইনিংস।
প্রোটিয়া অধিনায়ক বাভুমার কথাও না বললেই নয়। দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় ১৩৪ বলে ৬৬ রানের হার না মানা এক ইনিংস খেলেছেন তিনি। ৫ ঘণ্টারও অধিক সময় উইকেটে ছিলেন বাভুমা। তবে এর মধ্যে অর্ধেক সময়ই দৌড়েছেন খুড়িয়ে খুড়িয়ে। প্রথম ইনিংসেও তার ব্যাট থেকে আসে ৩৬ রান। দুই ইনিংসে ব্যাট হাতে দারুণ প্রতিরোধ দেখিইয়েছেন ডেভিড বেন্ডিংহাম। প্রথম ইনিংসে ৪৫ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি।
জয়ের আরেক বড় তারকা কাগিসো রাবাদা। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে অভিজ্ঞ পেসার নিজেকে প্রমাণ করেছেন বড় মঞ্চে। দুই ইনিংস মিলিয়ে তিনি নিয়েছেন ৯ উইকেট। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৪ উইকেট নিয়েছেন মার্কো জেনসেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট গেছে লুঙ্গি এনগিডির ঝুলিতে।
টস জিতে বোলিং নিয়ে প্রথম ঘণ্টায়ই অস্ট্রেলিয়াকে ব্যাকফুটে ফেলে দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। জেনসেন-রাবাদার তোপে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৭ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারায় অজিরা। মার্নাস লাবুশেন ও উসমান খাজার উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন রাবাদা। প্রথম স্লিপে আদায় করে নেন খাজার উইকেট। দ্বিতীয় উইকেটের জন্য রাবাদাকে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ওই ওভারেই তুলে নেন ক্যামেরন গ্রিনকে। গ্রিন ক্যাচ দেন স্লিপে দাঁড়ানো এইডেন মারক্রামকে।
লাবুশেনও ইনিংস বড় করতে পারেননি। উইকেটরক্ষক কাইলে ভেরাইনের গ্লাভসে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন জেনসেন। গত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের নায়ক ট্রাভিস হেড ফেরেন মাত্র ১১ রানে।
অভিজ্ঞ স্টিভ স্মিথ এবং বেউ ওয়েবস্টারের ব্যাটে শুরুর ৪ উইকেটের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। পঞ্চম উইকেটে ৭৯ রান তোলে এই জুটি। ৬৬ রান করেন স্মিথ। ওয়েবস্টারও পান ফিফটির দেখা। মাত্র ২০ রানের ব্যবধানে শেষ পাঁচ উইকেট হারিয়ে প্রথম ইনিংসে ২১২ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া।
তবে এই ২১২ রান নিয়েও প্রথম ইনিংসে লিড পায় অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দিনের শেষভাগে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়ার মতো শুরুতেই চাপে পড়ে প্রোটিয়ারাও। ৩০ রানে প্রথম ৪ উইকেট হারায় দলটি। দলের খাতায় কোনো রান যোগ হওয়ার আগেই স্টার্কের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন এইডেন মার্করাম। রায়ান রিকেলটন ১৬, উইন মুল্ডার ৬ আর ত্রিস্তান স্টাবস ২ রান করে আউট হন।
৪ উইকেট হারানোর পর ডেভিড বেন্ডিংহামকে নিয়ে হাল ধরেন বাভুমা। তবে তাদের ৬৪ রানের জুটি ভাঙেন কামিন্স। ৮৪ বলে ৩৬ রান করে বিদায় নেন প্রোটিয়া অধিনায়ক। এরপর কাইল ভেরেন্নে (১৩) ও ইয়ানসেনকেও (০) ক্রিজে স্থায়ী হতে দেননি কামিন্স। একপ্রান্ত আগলে রাখা বেডিংহ্যাম দলীয় ১৩৫ রানে বিদায় নেন। তার বিদায়ের পর দলের খাতায় আর মাত্র ৩ রান যোগ করতে পারেন বাকিরা। প্রথম ইনিংসে ১৩৮ রানে অলআউট হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।
২১২ রান করেও প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে লিড এনে দেয়ার নায়ক ছিলেন কামিন্স। অজি অধিনায়ক ওই ইনিংসে ২৮ রান দিয়ে নেন ৬ উইকেট। ২ উইকেট নেন মিচেল স্টার্ক।
টেস্টের সংক্ষিপ্ত স্কোর:
অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস: ২১২/১০, (ওয়েবস্টার-৭২ রান, স্মিথ- ৬৬); রাবাদা- ৫ উইকেট, ইয়ানসেন-৩।
সাউথ আফ্রিকা ১ম ইনিংস: ১৩৮/১০, (বেডিংহাম-৪৫ রান, বাভুমা-৩৬); কামিন্স- ৬ উইকেট, স্টার্ক-২।
অস্ট্রেলিয়া ২য় ইনিংস: ২০৭/১০, (স্টার্ক-৫৮*, ক্যারি-৪৬); রাবাদা-৪ উইকেট, ইনগিডি-৩।
সাউথ আফ্রিকা ২য় ইনিংস: ২৮৫/৫, (মার্করাম ১৩৬, বাভুমা-৬৬); স্টার্ক-৩ উইকেট।