নিজস্ব প্রতিবেদক: মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কন্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম নিজ দল আওয়ামী লীগের শাসনামলে বরারই ছিলেন আলোচিত- সমালোচিত। কখনো সংসদ অধিবেশনের সময় দলীয় প্রধানের মন জয় করতে গান গেয়ে, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শহীদ হওয়ার নানা রকম ব্যাখা, ফেরি করে বিদ্যুৎ বিতরণের বক্তব্যের পাশাপাশি নিজ এলাকার দলীয় সভা-সমাবেশে জেলা আওয়ামীলীগের বর্ষীয়ান নেতাদের কটাক্ষ করে মন্তব্য করায় ছিলেন বিতর্কের শীর্ষে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন মমতাজ বেগম। এরই মধ্যে মমতাজের বিরুদ্ধে নিজ নির্বাচনী এলাকার থানা ও আদালতে হত্যা ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে হাফ ডজন মামলা হয়েছে। তার পৈতৃক বাড়ি মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জয়মন্টপ ইউনিয়নের পূর্বভাকুম গ্রামের বাউল কমপ্লেক্স (মিউজিয়াম), মধু মঞ্চ ও মধুর আড্ডা নামের রেস্টুরেন্টে ভুতুরে অবস্থা বিরাজ করছে। প্রতি বছর ১লা জানুয়ারি থেকে তিনদিন ব্যাপি মমতাজের বাবা প্রয়াত মধুর বয়াতির নামে মেলার ছন্দ পতন ঘটতে যাচ্ছে এবার।
জানা গেছে, হেমায়েতপুর-সিংগাইর-মানিকগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে পূর্ব ভাকুম গ্রামে অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে মমতাজ বেগমের বাড়ি। পাশেই মধু-উজালা কোল্ড স্টোরেজ, বাউল কমপ্লেক্স, মধু মঞ্চ ও সর্বশেষ চালু করা হয় ‘মধুর আড্ডা’ নামের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। এক সময় মমতাজের বাড়িসহ এ এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছিল নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মধু মঞ্চেই এ এলাকার আওয়ামীলীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আড্ডাস্থল ছিল। রাজনৈতিক কর্মসূচীর যাবতীয় সিদ্ধান্ত এখান থেকেই নেয়া হতো। মমতাজ যখন বাড়িতে অবস্থান করত তার অনুসারীরা তার চারপাশ সরগরম করে রাখতেন। পাশাপাশি গাড়ির বহর লেগেই থাকত। গেল ৫ আগষ্টের পর বদলে গেছে সেই চির চেনা দৃশ্য। সেখানে এখন ভুতুরে অবস্থা বিরাজ করছে।
বাড়ির মালিক সাবেক সংসদ মমতাজ বেগম আত্নগোপনে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানা ও আদালতে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে রাজধানী ঢাকার হাতিরঝিল থানায় একটি, সাভারের আশুলিয়া থানায় একটি. তার নির্বাচনী এলাকার মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় একটি , সিংগাইর থানায় দুইটি ও মানিকগঞ্জ কোর্টে একটি। এসব মামলায় হত্যা , হত্যা চেষ্টা ও নাশকতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরে মমতাজের নিজ বাড়ি জয়মন্টপ ও পূর্বভাকুম গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীতে যখন উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয় মমতাজ বেগম তখন থেকেই গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের খবর পেয়ে সে বিকেলে তার বড় ভাই এবারতের বাড়ি উপজেলার জয়মন্টপ ইউনিয়নের চরদুর্গাপুর গ্রামের চলে যান। সেখানে দুই-তিন মাস থাকার পর কোন এক সময় ছদ্মবেশ ধারণ করে অবস্থান বদলে আত্মগোপনে চলে যান। এর মধ্যে বিক্ষোকরীরা তার মধুর আড্ডার গ্লাস ও প্রবেশ পথের লাইটগুলো ভাংচুর করে।
মধুর আড্ডা রেস্টুডেন্টের দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি গার্ড রংপুর জেলার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ৫ আগষ্টের পর দিন একদল দুর্বৃত্ত রেস্টুরেন্টের ভিতরে হামলা চালিয়ে ভাংচুরসহ ৪ লাখ টাকার মালামাল লুট করেছে।
মমতাজ বেগমের বাড়ি ও বাউল কমপ্লেক্সের দায়িত্বে থাকা যশোর জেলার বাসিন্দা আরেক সিকিউরিটি আনন্দ কুমার দত্ত জানান, টেলিভিশনে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবর দেখে মমতাজ ম্যাডাম বাড়িসহ সকল জায়গা জমি আমাকে দেখভাল করার কথা বলে বের হয়ে যান। এর পর থেকে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। মাস শেষে ম্যাডামের বড় ভাই এবারত পীরসাব আমার বেতন দিয়ে যান। বাউল কমপ্লেক্সের ভিতরে যেতে চাইলে মালিকপক্ষের নিষেধ আছে বলে জানান সিকিউরিটি আনন্দ কুমার দত্ত।
এদিকে. শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার কিছু দিন পর সোস্যাল মিডিয়া থেকে সটকে পড়েন মমতাজ। এদিকে হঠাৎ গত ১৩ অক্টোবর বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও পোষ্ট করেন মমতাজ। ৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে তাকে “ আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধবি কেমনে ? আর চোখ বান্ধবি,মুখ বান্ধবি পরাণ বান্ধবি কেমনে ?” গানটি পরিবেশন করতে দেখা গেছে। ভিডিওটি মুহুর্তের মধ্যে নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে নেতিবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি কিছু ইতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা গেছে নেটিজনদের। এর আগে ছাত্র জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে ছিল ৪ আগষ্ট ফেসবুকে তার নিজ নামে হাসপাতাল ভাংচুরের কয়েকটি ছবি দিয়ে পোষ্ট দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে দুইটি পোষ্ট ফেসবুক থেকে সরিয়ে ফেলেন সামালোচিত সাবেক এ সংসদ সদস্য।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতা গঠনের পর সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মমতাজ বেগম। এরপর দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মানিকগঞ্জ-২ (সিংগাইর-হরিরামপুর ও সদরের ৩ ইউনিয়ন) ২০১৪ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও ২০১৮ সালে একতরফা নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ থেকে নৌকার টিকেট পেলেও নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ ট্রাক প্রতীকের দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর কাছে পরাজিত হন মমতাজ বেগম।