মাকসুদুর রহমান: আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জোরালো তৎপরতার পরও মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় অপরাধ প্রবণতার লাগাম যেন টানাই যাচ্ছে না। দলবদ্ধভাবে একের পর এক ছিনতাই, চুরি ডাকাতি, হত্যার মতো জঘন্য সব অপরাধ ঘটছে নিত্যনৈমিতিক। এবার এমনই একদল দুর্বৃত্ত বা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ ওয়ালটনের কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম মিল্টন। আশপাশের লোকজনের সহযোগিতায় তিনি প্রাণে কোনমতে রক্ষা পেলেও ছিনতাইকারীরা তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
ভুক্তভোগি এ ঘটনায় আদাবর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সোমবার (১৯ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৮ টার দিকে রবিউল নামে ওই কর্মকর্তা বাজার সেরে ফিরছিলেন। আদাবর থানা এলাকার ৯/১০ নম্বর গলির মাথায় আসা মাত্রই ৫ জন ছিনতাইকারি ধারালো অস্ত্র নিয়ে তার গতিরোধ করে। ভয়-ভীতি দেখাতে থাকে, করে শারীরিক প্রহারও। ঘিরে ধরে সঙ্গে থাকা ব্যাগভতি ল্যাপটপ, মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ দৃশ্য দেখে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে ছিনতাইকারীরা তার ব্যাগটি ফেলে যায় পালিয়ে যায়। তবে। মোবাইলটি নিয়ে যায়।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে অভিযান পরিচালনা করলেও মঙ্গলবার (২০ নভেম্বর) দুপুরে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মোবাইলটি উদ্ধার কিংবা কাউকে আটক করতে পারেনি।
আদাবর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইমতিয়াজ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা শুরু তদন্ত করছি। তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের আইনের আওতায় দ্রুতই নিয়ে আসা হবে, পাশাপাশি মোবাইল উদ্ধারে প্রযুক্তির সহযোগিতা নেয়া হয়েছে।’
ভুক্তভোগী বলেন, ‘প্রকাশ্যে যেভাবে তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে আমাকে ভয় ভীতি দেখিয়েছে, যদি আমি কোন ধরনের কথাবার্তা বলতাম তাহলে হয়তোবা জীবনের উপর দিয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। যাই হোক আল্লাহ রক্ষা করেছেন। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ‘
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর আগে মোহাম্মদপুরে ১১ অক্টোবর গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনা সবার মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তবে ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ডাকাতিতে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে র্যাব ও ডিবি। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরেই দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মুখে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সকাল সোয়া ১০টার দিকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৩ নম্বর সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী একটি গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ডাকাত দলের সদস্যরা। গত ১০ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় রবিউল ইসলাম (৩৫) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। এছাড়া গত ১৬ অক্টোবর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে মো. শাহনেওয়াজ (৩৮) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়।
নিহতের বোন নাসরিন আখতার বলেন, তার ভাই নারায়ণগঞ্জে একটি দোকানে কাজ করতেন। রাতে মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে গোলাগুলি হয়। ওই সময় শাহনেওয়াজ গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
১৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ কাঁচাবাজার মার্কেট দখলকে কেন্দ্র করে গুলির ঘটনা ঘটে। মার্কেটের সভাপতি আবুল হোসেন (৫০) ও তার ছোট ভাই মাহবুবকে (৪২) গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি মোটরসাইকেলে করে তিনজন ব্যক্তি বাজারে আসে। এছাড়াও চলতি মাসে আরও অনেক অপরাধ সংঘটিত হলেও ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই থানা পুলিশে অভিযোগ করতে আগহ কম দেখাচ্ছে। ছিনতাই-ডাকাতির শিকার হয়েছেন এমন অনেকে পুলিশি সহয়তা নেয়নি। অর্থাৎ জিডি কিংবা মামলা করেনি। কারণ হিসেবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, থানা-পুলিশ-আদালতের ঝামেলা এড়াতে পুলিশের শরণাপন্ন হননি তারা। অনেক ভুক্তভোগী আবার ডাকাতির শিকার হয়ে থানায় যেয়ে ছিতাইয়ের মামলা করেছেন। তবে পুলিশ বলছে, জিডি-মামলা না করলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা মুশকিল, একইসঙ্গে অপরাধীদের শনাক্ত করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। অবশ্য এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব এলাকায় বেশি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটবে সেসব এলাকার ওসিসহ দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মোহাম্মদপুর অশান্ত:
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে অবৈধ মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, বাজারসহ নানা খাত দখলে নিতে মরিয়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একাধিক গ্রুপ। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে অশান্ত মোহাম্মদপুর। নিজেদের আধিপত্য জানান দিতে লিপ্ত হচ্ছে সংঘর্ষে। এসব সংঘর্ষে প্রদর্শন ও ব্যবহার করছে অবৈধ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, হচ্ছে রক্তপাত। সেই সঙ্গে ঝরছে জীবনও। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মোহাম্মদপুর এলাকার পেশাদার ছিনতাইকারী চক্রও।
পুলিশের একাধিক সূত্র বলছে, বেশিরভাগ চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি ঘটছে মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। গত দুই মাসে যেসব ছিনতাই ঘটেছে সবই এ সময়ের মধ্যে। এর মধ্যে ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, সড়ক, বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারা বেশি হানা দিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে। আর ভোরের দিকে বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও নিরিবিলি-অনেকটা বিদ্যুৎহীন অন্ধকার সড়কে রিকশাযাত্রীদের নিশানা বানিয়েছে ছিনতাইকারীরা।
ডিএমপির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছিনতাইকারী বেশি রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলানগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায়। এসব অপরাধে জড়িতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্তও রয়েছে। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে তেজগাঁও বিভাগে। সবচেয়ে কম মিরপুর বিভাগে।
ডিএমপির একটি সূত্র বলছে, গত দুই মাসে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি বেড়েছে। ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার প্রতিটি থানার ওসিকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি হবে সে এলাকার ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনা একটি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। থানার ওসিকে প্রতি সপ্তাহে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে হয়। ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা হলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এবং সংশ্লিষ্ট থানার ওসির ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ। রাজধানীতে রাত-বিরাতে চলাচলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায় কেউ না কেউ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন, খোয়াচ্ছেন সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার কিংবা টাকা-পয়সা। বাধা দিলেই ছিনতাইকারীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অনেকে হচ্ছেন আহত, ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। আগের মতো পুলিশি টহল না থাকার সুযোগ নিচ্ছে ছিনতাইকারী ও ডাকাতরা।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস্) মো. ইসরাইল হাওলাদার বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে সবার মধ্যে স্বাধীন স্বাধীন ভাব ছিল। প্রত্যেকটি থানায় ৫ থেকে ৮টি করে টহল গাড়ি ছিল। এ গাড়িগুলো ৫ তারিখের পর অনেক থানায় ছিল না। যে থানায় বেশি গাড়ি ছিল সেখান থেকে অন্য থানায় বন্টন করে টহল কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। ৮টি টহলের জায়গায় একটি টহল কার্যক্রম প্রথম দিকে শুরু করা হয়। দুই মাসের মাথায় বর্তমানে সব থানায় মোটামুটি টহল কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে। একটা ঘটনা ঘটার পর তদন্তে দিনরাত পরিশ্রম করে আমরা আসামি শনাক্তের পর আসামিও ধরেছি। মোহাম্মদপুরে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোহাম্মদপুরে আগের চিত্র চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-খুনের মতো ঘটনা ছড়াছড়ি। তবে বর্তমানের পরিস্থিতি আমাদের কন্ট্রোলে রয়েছে। অপরাধ চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে অপরাধ হলে যাতে চিহ্নিত করা যায় এবং অপরাধীদের শনাক্তের পর আইনের আওতায় আনা হবে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত রয়েছেন। রাজধানীতে রাতের বেলায় বিশেষ করে ভোরের দিকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশ উদ্বিগ্ন খোদ ডিএমপির পুলিশ কর্মকর্তারাই।
সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে শাহবাগ, ভাটারা ও শেরেবাংলানগর থানা এলাকায়। আর সবচেয়ে কম ছিনতাইকারী ও ডাকাতের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে দক্ষিণখান, উত্তরখান ও উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায়। ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের (আইনের ভাষায় দস্যুতা) ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও মামলা নিতে চায় না থানা পুলিশ। মোবাইল বা মানিব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানা পুলিশ মামলা নেওয়ার বদলে জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দিয়ে থাকে। অনেক সময় ভুক্তভোগীরাও ঝামেলা এড়াতে জিডি করেই চলে আসেন। অথচ দণ্ডবিধি বা পুলিশ প্রবিধানে ঘটনার বর্ণনা অনুযায়ী মামলা বা জিডি নেওয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের মামলা কেন নিতে চায় না পুলিশ?