ইমা এলিস, নিউ ইয়র্ক: বাংলাদেশের যে কোন সরকার ব্যবস্থায় অবশ্যই জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। জবাবদিহিতা না থাকলে সরকারের উপর সাধারন মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে। সাগর রুনির হত্যার বিচার ৪৮ ঘন্টা থেকে এখন ৪৮ বছরের অপেক্ষায়। সেনানিবাসের মতো নিরাপত্তা বেষ্টনি এলাকায় তনু ধর্ষণ। যার রহস্য আজও কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। সর্বজনীন পরিবহণে নিত্যদিনের যৌন হয়রানি থেকে মাদ্রাসায় বলাৎকারের মতন জঘন্য দুর্ঘটনা অহরহ ঘটেছে আমাদের সোনার বাংলায়।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের একটি রেস্তোঁয়ার যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এবং এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এবং এলামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে ইউসুফ আলী লিখিত বক্তব্যে বলেন, ভূমিদখল, প্রসাশনিক কাজে ঘুষ, লাঞ্চের পর আসেন কালচার, ঘাট থেকে শুরু করে টোল বুথের নামে চাঁদাবাজি। সব কিছুই বন্ধ কেবল সেদিনই সম্ভব, যেদিন আইন সবার জন্য সমান হবে। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত, এবং সুপ্রিম কোর্টকে স্বাধীন করতে হবে। যখন দেশের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে চিফ জাস্টিস সহ সকল উচ্চ পদস্থ বিচারকমণ্ডলী পদত্যাগ করতে চায়, তখন আপনাকে আমাকে বুঝতে হবে এই বিচার ব্যবস্থা কতটা কোরাপ্টেড, ম্যানুপুলেটেড এবং একতরফা ছিলো। আপনি বলতে পারেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আদালত আস্থা হারিয়েছে। ওয়েল, ইন দ্যাট কেস আদালত একমাত্র উইং যারা জনগনের পক্ষে কিংবা নিউট্রাল গ্রাউন্ড থেকে সরকারকে পরামর্শ দিতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে আদেশ করতে পারে। সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি একমাত্র কোরাপশান আর দলীয় মতাদর্শ না থাকলে এহেন গুরুদায়িত্ব ছেড়ে পালাবার কথা কেউ ভাববে না। তবে বিগতদিনের কালো অধ্যায় ছাপিয়ে আমরা চাই কন্সটিটিউশনাল ল’ কে সংস্কার করতে, ব্রিটিশ শাসনের শিখিয়ে যাওয়া নানান অসংগতিপূর্ন বিচার ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে সকলের জন্য সমান আইন নিশ্চিত করতে।
তারা উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক দল ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের মত মহান অর্জনকে নিজের দলের স্বার্থে ব্যবহার করে দেশের সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিতো একটা চরমপন্থী পরিচয়ের দিকে। গনতান্ত্রিক সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ ছিলো এটা। আমরা চাই বাংলাদেশে এমন বাইনারি রাজনীতি আর থাকবে না। আমরা বিএনপি বনাম আওয়ামিলীগ, হিন্দু বনাম মুসলিম, জামাতি বনাম বামাতি, প্রগতিশীল বনাম প্রতিক্রিয়াশীল দেখতে চাইনা। পরবর্তী সরকার কেবিনেটে আমরা চাই একটা মিশ্র পার্লামেন্ট যেখানে সবাই যুক্তিতর্কের মাধ্যমে দেশের প্রয়োজনীয় উন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে কাজ করবে।
শিক্ষার্থীরা বলেন, একটা গনতান্ত্রিক দেশের মূলনীতি সবসময় “অফ দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল নীতিতে চলে।” যখন আপনি এখানে একটা “কিন্তু, অথচ, অথবা” নিয়ে আসতে চাইবেন তখনই দেশে ডিক্টেটরশিপ বা একনায়কতন্ত্র কায়েমের পক্ষে আপনি কথা বলছেন। সুতরাং জনগনের দ্বারা নির্বাচিত, জনগনের টাকায় চলা জনপ্রতিনিধিকে প্রপার এডুকেটেড হতে হবে। সেটা সেন্ট্রাল গভমেন্ট থেকে লোকাল গভমেন্ট পর্যন্ত। মিনিমাম একটা লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা না থাকলে তারা প্রতিনিধিত্ব করার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। সেই সাথে নির্বাচন কমিশনকে হতে হবে নির্ভিক এবং প্রত্যেক টার্ম শেষে ফেয়ার ইলেকশন নিশ্চিত করতে হবে। ভোটডাকাতি, রাতের ইলেকশনের মতোন টার্ম বিলুপ্ত করতে হবে। এবং ইলেকশন সম্প্রচারের এক্সেস ইজি করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি গার্মেন্টসের পরেই কৃষি। আমাদের দেশের কৃষক শ্রমিকদের অবস্থা বোধ করি এখন সবচেয়ে খারাপ। দেশের জিডিপি ২৬৮৮.৩১ পয়সা। যেখানে কৃষকেরা সামান্য সারটুকু কিনতে হিমসিম খায়। আমাদের পাটকল, চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের চা শ্রমিকেরা নামে মাত্র মজুরি পাচ্ছে। শিল্প কারখানায় বেতন আটকে রাখা হচ্ছে। দেশের সরকার যদি এনার্জির সাপ্লাই সবচেয়ে বেশি দিয়ে থাকে, তবে সেটা শিল্প কারখানায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ, এবং ভর্তুকি এ সবকিছু নিয়ে ক্যাপিটালিস্ট শ্রেণী অধিক মুনাফা অর্জন করেই যাচ্ছে আর এসবের পিছে গরীব শ্রমিক শ্রেণী এখনো দিনের নায্য মজুরি টুকু পাচ্ছে না। মার্কেট লবিং করে অল্প দামে ফসলাদি কিনে মজুদ করে বাজারে পন্যের কৃত্তিম সংকট তৈরি করে অধিক দামে একই ফসলাদি বিক্রি করা হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল থেকে কাঁচাবাজার পর্যন্ত এর অন্তর্ভুক্ত। কিছুদিন আগে মাংসের বাজার কেমন ছিলো আমরা সবাই দেখেছি। রমজান মাসে বাজার কেমন থাকে তাও আমাদের অজানা নয়।
ইউসুফ আলী লিখিত বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সংস্কার এবং উন্নয়নের জন্য যে রাস্তায় আমাদের হাঁটা দরকার, সেই রাস্তা অনেক লম্বা। স্বাধীনতার অর্ধশতক পার করেও আমরা হয়তো বুঝিনি, বুঝছিনা কিংবা ইচ্ছা করেই বুঝতে চাচ্ছিনা। আমরা মুখ খুলিনা, কথা বলিনা। আমরা বিগত বছরগুলোতে দেখেছি যাদের দ্বায়িত্ব ছিলো “কথা বলা” তারা কেবল চাটুকারিতা করে গেছে। যাইহোক, একটা অভ্যুত্থান আমরা করেছি কেবল মাত্র স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এটা সত্য এবং বাস্তব। একমাত্র একটি বিশেষ টিভি চ্যানেল ছাড়া আমাদের পক্ষে কাউকে কাজ করতে দেখিনি। আমরা এই লজ্জা আর চাইনা। আমরা চাই গণমাধ্যম উন্মুক্ত হোক, গনমাধ্যম কথা বলুক। আপনারা প্রশ্ন করলে দুর্নীতিবাজ দুর্নীতি করার আগে দুইবার ভাববে। ঘুষখোররা, ভেজালকারীরা,চাঁদাবাজরা যে কোনো অন্যায়কারীরা অন্যায়ের আগে দুইবার ভাববে। তাই বিগত বছরগুলোতে আপনাদেরকে যেমন কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিলো, সেই দশা থেকে বের হয়ে এই মুক্ত বাতাসের স্বাদ নিন। স্বাধীনতার থেকে শান্তিময় আর কি হতে পারে?
প্রবাসী হিসাবে সৈয়দ আল আমিন রাসেলসহ শিক্ষার্থীরা অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের কাছে দাবি করেন প্রবাসীদের জাতীয় পরিচয়পত্র যেন দ্রুত দুতাবাস থেকে সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকেই সরবরাহ করা হবে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকবে তারা আমেরিকার নাগরিক হলে আর বাংলাদেশি পাসপোর্ট লাগবেনা এমন প্রস্তাবনার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রস্থ বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এবং এলামনাই এসোসিয়েশনের অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, শারমিন আকতার, নুমায়ের হোসেন, অবনী শরীফ, মুজাফফর আহমেদ, বায়েজিদ কামাল এবং নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন সংবাদকর্মীরাও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।