মো. মিজানুর রহমান, এফসিএস || আগস্ট ৫, ২০২৪ ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন ও গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর ০৮-০৮-২০২৪ তারিখে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেন। যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ড. আহসান এইচ মনসুরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এরপর শুরু হয় ব্যাংক-লিজিং তথা আর্থিক খাতের সংস্কারের কাজ। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ১৭ জন করা হয়েছে।
ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই ব্যাংকিং খাতকে এস আলম মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুন:গঠন এর মাধ্যমে এস আলমের হাতে থাকা ৭টি ব্যাংক যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, ইউনাটেড কমার্শিয়াল (ইউসিবি) ব্যাংক ও আভিভা ফাইন্যান্স এর পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে পুন:গঠন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর। যেসব ব্যাংক ও লিজিং কোম্পানির পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে পুন:গঠন করা হয়েছে সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৫ জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ পেয়েছেন। পরিচালনা পর্ষদ পুন:গঠন হওয়া ব্যাংকের সবগুলোতেই একজন করে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (এফসিএ) বা পেশাদার হিসাববিধ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিছু সংখ্যক ব্যাংকে কস্ট এন্ড ম্যানজেমন্টে অ্যাকাউন্ট্যান্ট (এফসিএমএ) নিয়োগ দেয়া হলেও কোন ব্যাংকের পর্ষদেই গর্ভনেন্স প্রফেশনাল বা পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজ (এফসিএস) নিয়োগ দেয়া হয়নি।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে গর্ভনেন্স প্রফেশনাল হিসেবে চার্টার্ড সেক্রেটারিজ এ্যাক্ট-২০১০ এর আওতায় ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) এর পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজ সদস্যরা (এফসিএস) কাজ করছেন। আইসিএসবিতে বর্তমানে কম-বেশি প্রায় ৭শ সদস্য তালিকাভুক্ত রয়েছেন। যাদের ৩৯৩ জন এফসিএস সদস্যের মধ্যে পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজ ফার্ম রয়েছে ২১টি। যারা বাংলাদেশে কর্পোরেট সেক্টরে তথা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩ শতাধিক প্রতিষ্ঠানে কর্পোরেট গর্ভনেন্স অডিটর এবং ইনডিপেনডেন্ট স্কুটিনাইজার হিসাবে সুনামের সাথে কাজ করছেন ও বাকি ৩ শতাধিক এসিএস সদস্য হিসাবে আছেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৩০০/৪০০ লিস্টেড কোম্পানি ও ১০০/২০০ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিতে আইসিএসবির সদস্যরা গর্ভনেন্স প্রফেশনাল বা কোম্পানি সচিব (এসিএস/এফসিএস) হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ ১০/১২টি ব্যাংকের পুন:গঠিত পর্ষদের একটিতেও একজন পেশাদার গর্ভনেন্স প্রফেশনাল বা পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজ (এফসিএস) নিয়োগ দেয়া হয়নি।
বিষয়টি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) এর সদস্যদের জন্য খুবই বৈষম্যমূলক এবং অসম্মানজনক মনে করছেন কর্পোরেট সেক্টর নিয়ে কাজ করা প্রফেশনাল ইনস্টটিউিট আইসিএসবির সদস্যরা তথা সিএস পেশাদারগণ। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এর একটি বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। পরিচালনা পর্ষদে গর্ভনেন্স প্রতিষ্ঠা বা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই প্রত্যেকটি ব্যাংক, লিজিং, ইন্সুরেন্স ও অন্যান্য কোম্পানিতে পেশাদার কর্পোরেট গর্ভনেন্স প্রফেশনাল বা পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজ (এফসিএস) সদস্যকে পুন:গঠিত পরিচালনা পর্ষদে অন্তত একজন করে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে।
বৈষম্যহীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আপনারা কর্পোরেট সেক্টর নিয়ে কাজ করা ৩টি প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটের সদস্যদের নিয়ে বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন, না হয় আইসিএসবির প্রফেশনালদের ব্যাপারে অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন। কর্পোরেট সেক্টরে গর্ভনেন্স প্রতিষ্ঠার জন্য আপনারা যে সকল প্রতিষ্ঠানে পর্ষদ পুন:গঠন করেছেন এবং করবেন সেখানে অবশ্যই একজন পেশাদার গর্ভনেন্স প্রফেশনাল বা পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজ (এফসিএস) সদস্য স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র পেশাদার হিসাববিদদেরকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েই পূর্নগঠিত বোর্ড তথা কোম্পানিতে গুড গভার্নেন্স প্রতিষ্ঠা পাবে না। এটা আপনাদেরকে বুঝতে হবে। আর যদি অজ্ঞতার কারণে বা সিএস প্রফেশন সম্পর্কে না জানার ফলে এমন বৈষম্যমূলক আচরণ হয়ে থাকে তবে তার দায় কোন ভাবেই ২০১০ থেকে এখন পর্যন্ত কাজ করা কাউন্সিল সদস্য ও প্রেসিডেন্টগণ এড়াতে পারেন না। আপনাদের ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন গভর্নর সিএস প্রফেশনকে চিনেন না, এটা মেনে নেয়া যায় না।
বিগত ১৪ বছর যারা আইসিএসবির কাউন্সিলে প্রেসিডেন্ট, সিনিয়র প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কোষাধ্যক্ষ সহ বিভিন্ন পদ অলংঙ্কিত করেছেন তারা কি সিএস প্রফেশনের এমন কলঙ্কের দায়ভার মাথা পেতে নিবেন, নাকি এড়িয়ে যাবেন?
কেন এত বছরেও পেশাদার চার্টার্ড সেক্রেটারিজদের (এফসিএস) সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানেন না, বিআরপিডিতে কেন এখনও সিএস প্রফেশনকে বিএসইসির মতো তালিকাভুক্ত কেন হলো না, কেন ব্যাংকের পুন:গঠিত পর্ষদে একজন পেশাদার এফসিএস সদস্যও স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেন না, এর দায়ভার কার?
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশের (আইসিএসবি) একজন সম্মানিত ফেলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের প্রজ্ঞাপনে ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড পূর্ণগঠনে নাম ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। যেখানে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে মোঃ আবদুস সালাম এফসিএ, এফসিএস এর স্থলে এফসিএ, এফসিএমএ লেখা হয়েছে। এবং অফিসিয়ালী তার কোন প্রতিবাদ পর্যন্ত আইসিএসবি থেকে করা হয়নি। প্রতিবাদ করলেও অন্তত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বুঝতেন যে শুধু এফসিএ, এফসিএমএ না এফসিএস নামেও কর্পোরেট প্রফেশনাল বাংলাদেশে আছেন, ফলে পরবর্তী সময়ে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্তক হতেন।
ঠিক কিনা, চার্টার্ড সেক্রেটারিদের মতামত কি?
লেখক: সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।