।। বদরুল ইসলাম বাদল ।। অভিবাসী বলতে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে অর্থ উপার্জন বা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অন্য দেশে গিয়ে এক বছরের অধিক অবস্থান করাকেই বুঝায়।অন্যদিকে প্রবাসীও তারা, যারা কাজের বা পড়াশোনার জন্য অন্য দেশে বাস করে। তবে ছোট্ট একটি পার্থক্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি অন্য দেশে গিয়ে অবস্থান করে, সেখানকার মানুষের কাছে তিনি অভিবাসী, আর ঐ ব্যক্তিটিই নিজের জন্মভূমির কাছে প্রবাসী হিসেবে পরিচিত হয়। ভিন্নদেশে নতুন পরিবেশে অভিবাসীটির দরকার পড়ে নিরাপত্তার তেমনিভাবে সেই প্রবাসীর রেখে যাওয়া পরিবার ও তার সদস্যের নিরাপত্তা নিয়েও খেয়াল রাখা জরুরী। সেই চিন্তা থেকে বিপুলসংখ্যক অভিবাসীদের স্বার্থরক্ষায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং তাদের পরিবারের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার নিমিত্তে ১৯৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে ছিল। সেই সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন পর্যালোচনার মাধ্যমে ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ১৮ ডিসেম্বরকে “আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস” ঘোষণা করে। সভ্যতা বিকাশের পর থেকে মানুষ একদেশ থেকে অন্যদেশে কাজের খুঁজে আসা-যাওয়া করে আসছে।
উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় বর্তমানে ও সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে মানুষ পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্রের কাঠামোতে অভিবাসী এবং তাদের পরিবারের সুরক্ষার বিষয়টি তাই আরো জরুরী হয়ে দাড়িয়েছে। ইদানীং অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি সমৃদ্ধি অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স নির্ভর হয়ে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে এক কোটি বিশ লাখের বেশি বাংলাদেশের মানুষ। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি, জিডিপির ১২% প্রবাসী রেমিট্যান্স থেকেই আসে। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ নির্ভর করে অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর। এই বাস্তবতায় অভিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব।
পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে অভিবাসীরা। বিভিন্ন দেশ প্রবাসীশ্রমিকদের ছাঁটাই করছে।লঘুদোষে গুরুদণ্ড দিয়ে জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদিআরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ এবং শ্রমিক নিগ্রহের শিকার এসব দেশে সবচেয়ে বেশী। বিশেষ করে নারীশ্রমিক নির্যাতনের ভয়ার্ত চিত্র। কিন্তু বাংলাদেশী মিশনগুলোতে প্রবাসীরা পর্যাপ্ত সহযোগিতা পায় না। সেবাপেতে মিশনে নানাবিধ হয়রানি ও অবহেলার সম্মুখীন হয় ।বিদেশের মাটিতে অভিবাসীদের সময়ের দাম অনেক বেশি। ছোট কাজেও অনেক সময়ক্ষেপণ করে মিশনগুলো। মিশনে চাকরি করা সাহেবরা কামলা হিসেবে আচরণ করে প্রবাসীদের সাথে। যে অল্পশিক্ষিত অশিক্ষিত শ্রমজীবীদের ঘামেঝরা টাকায় দেশের উন্নয়নের গতি বেগবান তাদেরই অসম্মান করতে দ্বিধাবোধ করে না তাঁরা। পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের কোন প্রবাসীদের যে কোন সমস্যায় ফোন করার সাথে সাথে তড়িৎ কার্যকর ভূমিকা রাখে তাদের বিদেশ মিশন। বাংলাদেশের মিশনগুলোতে অভিবাসীদের অবহেলার বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট ।
এই নিয়ে অভিবাসনবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্যসচিব মাহজাবিন খালেদ উল্লেখ করেন যে “আমরা প্রবাসী আয় নিয়ে যতটা আহ্লাদ প্রকাশ করি, এর পিছনের তিক্ত গল্পটি তত বলি না।বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে প্রবাসীবান্ধব করার পাশাপাশি তাদের সক্ষমতা বাড়ানো উচিত”। এসব সহ্য করেও বিদেশের মাঝে মাটিকামড়ে পড়ে থাকে পরিবারের সুখের আশায় অভিবাসীরা। বিমানবন্দরে বিদেশফেরত প্রবাসীদের অবহেলার কথা মিডিয়ার সামনে হয়ে থাকে বিধায় সহজে প্রকাশ পায়।তবে এর বাইরের সমস্যাগুলো নিয়ে উদাসীনতা সর্বক্ষেত্রে। শুধু তাই নয়, দেশে আসার পরও অধিকাংশ প্রবাসীদের নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করেই যেতে হয়।অযাচিত হামলার শিকার হয় অনেকে।
খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসীদের উপর নানাবিধ অত্যাচার, অবজ্ঞা এবং বঞ্চনার সংবাদ। । টুনকো অজুহাতে প্রবাসী পরিবার হেনস্থা, চাঁদাবাজি, বাড়ি ডাকাতি, জমি বেদখল, মহিলা সদস্যদের ইভটিজিং সহ ইত্যাদি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো প্রশাসনিক সহযোগিতার ধীরগতি। সমাধানের দীর্ঘসূত্রীতা।যে কোন সমস্যায় জনপ্রতিনিধি, থানা, আদালত করতে যে সময় লাগে তা প্রবাসীদের সীমিত ছুটির সময়ে সম্ভব হয় না। ফলে তারা প্রশাসনমুখী হতে চায় না। এই সুযোগটিই নিতে চায় সুযোগ সন্ধানী কুচক্রী মহল। প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয়ে থাকে নিজেদের আপনজন আত্মীয়স্বজনের কাছে। দেশ থেকে দুরে থাকেন বলে প্রবাসীদের মাঝে দেশের মানুষের প্রতি মায়া, ভালবাসা আর আবেগটা বেশী থাকে। তাই সুখে দুঃখে আত্নীয়দের পাশে থাকতে চায়। অনায়াসে বিশ্বাস করে ফেলে। ভরসা করে।পরদেশে যারা থাকে তারাই বুঝতে পারে বিদেশের মাটিতে কি কষ্ট। পরিবারের উন্নত জীবন ও পরবর্তী সময়ে কিছুটা সুখের আশা নিয়ে দেশে ফিরে এসে উপার্জন করতে পারেন এমন কিছু ভাবতে থাকেন প্রবাসীরা। এই সুযোগটাই গ্রহণ করে বিশ্বাসঘাতক স্বজনরা।আবেগের জায়গায় হাত দিয়ে দেশে লোভাতুর আকর্ষণীয় পথ দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় বড় অংকের টাকা। সেখানেই ঠকে বেশী প্রবাসীরা।প্রতারিত হয়। আবার প্রতারণা প্রকাশ হয়ে গেলে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রশাসনের দারস্থ হতে বাধা সৃষ্টি করে।ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দোষ আড়ালের অপচেষ্টা করে। সমাজে এমন সাধুশয়তানের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুখোশধারী এসব শয়তানরা ছড়িয়ে আছে জেলায় জেলায়। জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী কিংবা শিক্ষাবিদের লেবাসে। বর্ণচোরা এসব মানুষ সমাজে উচ্চবর্গের ভাল মানুষ সেজে দাপিয়ে বেড়ায়। এরা সামাজিক শত্রু। রাষ্ট্রের দুষমন। একজন প্রবাসী যখন নিজের দেশে পরমস্বজন কিংবা কাছেরমানুষের কাছে প্রতারিত হয় তখন নিজের উপর ভরসা হারিয়ে ফেলে। ফলে কাজে মন বসে না। মানষিক অস্থিরতায় বিষন্নতায় ভুগতে ভুগতে অসুস্থ হয়ে য়ায়। এরকম উদাহরণ অহরহ। সংক্রামক ব্যাধির মতো জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সমাজে এরকম সমস্যা। এসব ব্যাধি প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারলে প্রবাসীগণ হতাশ হয়ে বিদেশমুখী হতে চাইবে না অথবা প্রবাসে কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে উর্ধ্বমূখী
রেমিট্যান্স প্রবাহের উপর। তখন দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিতে ধীরগতি নেমে আসবে।
এসব সমস্যা থেকে উত্তরণেএকজন সমাজ সংস্কারক তার মতামতে বলেন, “রাষ্ট্র ‘প্রবাসী নিরাময় আইন’ প্রণয়ন করে তার প্রয়োগের সময়সীমা দ্রুত করা উচিত বলে মনে করি। এদিকে এ আইনে প্রবাসী ও প্রবাসীদের পরিবারের আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি”। এদিকে দেশে এবং দেশের বাইরে অভিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে ‘প্রত্যাগত প্রবাসী আওয়ামী ফোরাম’। আন্তর্জাতিক অভিবাসন দিবসে সংগঠনটি রাষ্ট্রের কাছে কয়েকটি দাবি জানিয়েছে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আল মামুন সরকার।
দাবি গুলো হলো-
(১) অভিবাসী ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রেখে রুটিন আইনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
(২) রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোতে কমপক্ষে ৫% প্রণোদনা সহায়তা প্রদান করতে হবে।
(৩) অভিবাসী পরিবারের সদস্যদের সামাজিক নিরাপত্তা ও সম্পদের সুরক্ষায় দায়িত্ব নিতে হবে।
(৪) যারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন তাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা ঘোষণা এবং বীমা ও পেনশনের আওতায় আনতে হবে।
কক্সবাজারে বর্তমানে বার লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের অবস্থান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মানবতার খাতিরে এদের জায়গা দিয়েছেন।কিন্তু তাঁরা নিজেদের অবস্থানকে স্থায়িত্ব করার জন্য নানাবিধ ছলচাতুরী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক শরনার্থী ও প্রত্যাবাসন সংস্থাদের উদাসীনতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় ঝুলিয়ে আছে তাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘদিন। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সল্প আয়তনের কক্সবাজার সহ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ডুকে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে,স্থানীয়দের সাথে রীতিমতো বেপরোয়া ভাবে ঝগড়াঝাটিতে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের উদার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। “আমরা কক্সবাজারবাসী” সামাজিক সংগঠন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্দোলনে আছে দীর্ঘদিন। কক্সবাজারের স্বার্থ রক্ষায় জেলার বৃহত্তর এই সামাজিক সংগঠনটি মতে ,”রোহিঙ্গারা অভিবাসী কিংবা প্রবাসী নয়, এরা তাদের নিজেদের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং ধর্মীয় নিগ্রহের শিকার হয়ে এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এনজিও সহ বিভিন্ন সাহায্যসংস্থা রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখে বাণিজ্য করছে। তাই তাদের প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান”। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে,আমাদের দেশের বিদেশফেরত অনেক শ্রমিক কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই যে, “যে রোহিঙ্গাদের আমরা জামাই আদরে জায়গা দিয়েছি। সে রোহিঙ্গাদের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে সৌদিয়াতে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয় বাঙালী অভিবাসী। রোহিঙ্গারা কৌশলে বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতিয়ে এসব দেশে এসে নানান অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। যখন সেখানকার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে,তখন তাদের হাতে থাকা পাসপোর্টের কারণে বাঙালী হিসেবে পরিচিত পায়। তখন বাংলাদেশের মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয় সেদেশের প্রশাসনের। ফলে বাঙালীদের ভিসা অনেকদিন সৌদিয়াতে বন্ধ থাকার পিছনে রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবনতা অনেকাংশেই দায়ী মনে করে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা অভিজ্ঞমহল। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট বাতিল করা নিয়ে বাঙালী অভিবাসীদের দীর্ঘদিনের আকুতি আর্তচিৎকার। এব্যাপারে রাষ্ট্রকে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সময়ের দাবি।
বিদেশে কর্মী নিয়োগ ব্যাপারে আমাদের দেশথেকে যে শর্তারোপ করা হয় তা প্রবাসীবান্ধব নয় মনে করে অভিবাসন বিশেষজ্ঞগণ। যেন দায়সারা ভাবে পাঠানো হলেই দায়িত্ব বুঝি শেষ।তাই চুক্তিকালীন প্রবাসীদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে নিরাপদ নিরাপত্তায় বিদেশমিশনের তড়িৎ হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।আর দেশে মর্যাদা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা, প্রশাসনের জোরালো নজরদারি। সর্বোপরি অভিবাসীদের সমস্যা নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রবাসী এবং তাদের পরিবার।
লেখক: সদস্য -বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি সাবেক ছাত্রনেতা ও সমাজকর্মী।