আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ। ১৯৫২ সালের সেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে জীবন দেয়া সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ ভাষা সৈনিকের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কারণে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা পেয়েছিলাম আমরা। মূলত এখান থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম এই ভাষা বিরোধের সূত্রপাত থেকেই বাঙালিরা তাদের নিজস্ব স্বকীয়তার কথা ভাবতে শুরু।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হবার পর বাঙালিদের বোধগম্য হতে থাকে যে ধর্মের ভিত্তিতে যে ভাগ হয়েছে তা নিতান্তই ভুল ছিল। কেননা সেই সময়ের পাকিস্তান রাষ্ট্রের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকের মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় অজুহাত দেখিয়ে উর্দুকে করা হয় রাষ্ট্রভাষা। প্রথম এই ভাষা বিরোধের কারণেই বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। কালের পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধও হয় এবং তার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি অর্জিত হয়। ইতিহাসবিদরা তাই এই ভাষা আন্দোলনকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বীজ হিসেবে চিহ্নিত করে।
পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য এ রকম সংগ্রামের ইতিহাস আর কথাও নেই। বাংলাদেশিদের এ অর্জনের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৯ সালে ইউনিস্কো এ ভাষা আন্দোলনকে ’আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এত অর্জন থাকার সত্ত্বেও আজ বাংলাদেশের অনেকের মাঝে মাতৃভাষার প্রতি তেমন কোন সম্মান দেখা যায় না। তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ আজ সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকছে। যে সাম্প্রদায়িকতার কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়ে তৎকালীন বাঙালিরা হারে হারে তাদের ভুল বুঝতে পেরেছিল, সেই আজকের একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে কিছু তরুণকে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি হতে।
তবুও পুরোপুরি আশা ছেড়ে দেয়া যায় না। এখনো সেই মাতৃভাষা প্রতি টান ফিরেয়ে আনা সম্ভব সেই সকল মানুষদের প্রতি, যদি আমরা পুনরায় তাদেরকে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডারের সাথে পরিচয় করানো শুরু করি। সেই সাথে নিজেদের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার প্রতি তরুণ প্রজন্মকে মনোনিবেশ করতে সহয়তা করি। সাম্প্রদায়িকতা দূরকরণে সেই সকল বিপদগামী তরুণদের যদি আমরা অসাম্প্রদায়িকতার পথ দেখাই, তাহলে তারাও এসব জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে সরে যাবে। আর এর সবই করা সম্ভব আমাদের ইতিহাসকে পক্ষপাতহীনভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারি। কেননা, এই পক্ষপাতহীন ইতিহাসই ওদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালবাসতে।
আজ এ মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সকল ভাষা সৈনিকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। সেই সাথে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষার প্রতিও সম্মান রইলো আমাদের। ’কোন ভাষাকে ঘৃণা নয়, মাতৃভাষাকে আর অবজ্ঞা নয়’- এ রকম মানসিকতার প্রয়াস হোক আমাদের সকলের।