তিমির বনিক, ষ্টাফ রিপোর্টার: ছোট্ট সোনা আমাতুল বারী নাফিসা। বয়স ৪ বছর ৬ মাস। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় এখন শিশুটির জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। গত ৯ জুন তাকে ভারতের ভেলোরে সিএমসি হাসপাতালে নিয়ে গেছেন তার বাবা-মা। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছে নাফিসা।
নাফিসার বাবা মো. নুরুল ইসলাম পূবালী ব্যাংক মৌলভীবাজার প্রধান কার্যালয়ে জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত এবং মা শারমিন আক্তার মৌলভীবাজারের কচুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা। এই দম্পতির অভিযোগ- ঢাকায় আনোয়ার খাঁন মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এহসানুল বারী রাহাতের ভুল চিকিৎসায় তাদের মেয়ের জীবন এখন সংকটাপন্ন। ইতোমধ্যে তারা চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসার বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জনসহ একাধিক জায়গায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, নাফিসার মাথার পেছনে একটি ব্রণ হয়। পরে চলতি বছরের ১০ মার্চ মৌলভীবাজার শহরের বেরিরপারস্থ রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডা. এহসানুল বারী রাহাতের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এক সপ্তাহের ওষুধে ব্রণটি না কমায় ঢাকায় আনোয়ার খাঁন মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত দেন ডা. এহসানুল বারী রাহাত।
নাফিসার অভিভাবকরা অপারেশন সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. এহসানুল বারী রাহাত বলেন, এটি সামান্য অপারেশন। ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন শেষ করে বাসায় নেওয়া যাবে এবং খরচ হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ডাক্তারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮ মার্চ নাফিসাকে আনোয়ার খাঁন মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন ওই দম্পতি। ওইদিন সন্ধ্যার পর অপারেশন করার জন্য নাফিসাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিছুক্ষণ পর ডা. এহসানুল বারী রাহাত নাফিসার বাবাকে ডেকে বলেন- আপনার বাচ্চার টিউমার ফেটে রক্ত ও ময়লা রক্তনালীর বিভিন্ন দিকে প্রবেশ করেছে। বাচ্চার অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ৮ থেকে ১০ ব্যাগ রক্ত লাগবে। চিকিৎসার জন্য নাফিসাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে এবং টাকা-পয়সাও লাগবে।
নাফিসার বাবা জানান, তিনি ডাক্তারের কথা বুঝতে না পেরে কর্তব্যরত ডাক্তার ও আরও দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে জানতে পারেন নাফিসার ভুল অপারেশন হয়েছে। নাফিসাকে এখন সিটিস্ক্যান করা হবে এবং হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হবে। পরে ১৯ মার্চ সকালে সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট দেখে পরবর্তী চিকিৎসা দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমরা সারারাত নাফিসাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রেখে বাহিরে অপেক্ষা করি। পরদিন সকালে জানতে পারি নাফিসার ব্রণটি হচ্ছে রক্তনালীর টিউমার। যাকে হেমানজিওমা বলা হয়। যা অপারেশন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পরবর্তীতে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তারদের নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। পরে বোর্ডের দায়িত্বশীলরা ডেকে বলে অপারেশনের সময় নাফিসার রক্তক্ষরণ হয়েছে। অধিক পরিমাণ রক্তক্ষরণের কারণে নাফিসার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
পরবর্তীতে মেডিকেল বোর্ডের নিউরো সার্জারি বিভাগের এক সিনিয়র ডাক্তার নাফিসার পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিয়ে অপারেশনের কাজ শুরু করেন। প্রায় ৪০ মিনিট পর ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে বলেন, আল্লাহর অশেষ কৃপায় আপনাদের বাচ্চার কোনো রক্তক্ষরণ হয়নি। ভালোভাবে সেলাই করে দিয়েছি। কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। পরবর্তীতে ২২ মার্চ হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়।
এ সময় ডা. এহসানুল বারী রাহাত বলেন, আগামী ২৪ মার্চ মৌলভীবাজার রয়েল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এলে সেলাই ড্রেসিং করবো এবং ৩১ মার্চ সেলাই কেটে দেব। তার কথা অনুযায়ী আমরা চেম্বারে গেলে ড্রেসিং করেননি। আগামী তারিখে একসাথে সেলাই কেটে দেবেন বলে আমাদের বিদায় করে দেন। ৩১ মার্চ মৌলভীবাজার শহরের জান্নাত প্রাইভেট হাসপাতালে সেলাই কাটতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতস্থানে পুঁজ জমে ইনফেকশন হয়ে মাংস পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। তখন ডাক্তার ড্রেসিং করেন এবং আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে আরও দুইবার ড্রেসিং করার কথা বলেন। এ রকম বিভিন্ন তালবাহানা করলে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সিনিয়র ডাক্তার আবু বক্কর মোস্তফাকে দেখালে তিনি বলেন, এখানে আবার সেলাই করা যাবে না। প্রতিদিন ড্রেসিং করে শুকাতে হবে। ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগবে।
নাফিসার বাবার অভিযোগ, রোগ সম্পর্কে না জেনে প্রযুক্তির যুগে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে ডা. এহসানুল বারী রাহাত ভুল অপারেশন করেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি ড্রেসিংও করেননি।
নাফিসার বাবা বলেন, ভুল চিকিৎসার কারণে মেয়ের যেভাবে ক্ষতি হয়েছে তেমনি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বর্তমানে ভারতের ভেলোরে সিএমসি হাসপাতালে তিন মাস যাবৎ নাফিসা চিকিৎসাধীন রয়েছে। এখানে প্রায় ১ বছর চিকিৎসা করাতে হবে। যার ব্যয় হবে ২০ লাখ টাকারও বেশি। তিনি ডা. এহসানুল বারি রাহাতের ভুল চিকিৎসার প্রতিকার চেয়ে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
মৌলভীবাজার রয়েল প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাহাদ আলমের দাবি, কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া নাফিসার চিকিৎসা করা ঠিক হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে ডা. এহসানুল বারী রাহাতের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার ফোন-ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি।
মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বলেন, ডা. এহসানুল বারী রাহাত নিউরো সার্জন নন। অপারেশন করা তার মোটেও ঠিক হয়নি। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।