ডা. মো. আবদুস শুকুর (শাকুর) : সাপের কামড়ের ঘটনাগুলো সাধারণত মে থেকে অক্টোবরে হয়ে থাকে। কারণ এই সময় ঝড়-বৃষ্টি হয়, চারদিকে পানি হয়, ডোবা নালা ভরে যায়। সাপ সাধারণত পানিতে থাকতে চায় না তাই উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়েই শুকনো জায়গার জন্য তারা খোঁজ শুরু করে। ঠাঁই নেয় বাসা-বাড়িতে আসে, রাস্তার আশপাশে, মাঠের পাশে প্রভৃতি শুকনো নিরাপদ স্থানে। মানুষ ও চলার জন্য, হাঁটার জন্য পানি এড়িয়ে ,কাঁদা এড়িয়ে শুকনো জায়গা দিয়ে হাঁটা শুরু করে। যোগফল যা দাঁড়ায় তার অর্থ হলো, এই মৌসুমেই তাই মানুষের সাথে সাপের বা সাপের সাথে মানুষের সাক্ষাৎ ঘটে। অযাচিত অপ্রয়োজনীয় হঠাৎ সেই সাক্ষাৎ কখনো কখনো প্রাণ বায়ু বের করে নিয়ে যায়। অঝোরেই ঝরে পড়ে তাজা প্রাণ।
তবে মানুষের সাথে সাপের সাক্ষাৎ হলেই সাপ কামড়াবে না। প্রথমত সাপ নিজেকে অনিরাপদ মনে করলে বা তার নিকের প্রাণের আশংকা থাকলেই সাপ কামড় দেয়।
সাপে কাঁটার তথ্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাখ ৩ হাজার মানুষকে সাপে কামড়ে দেয় এবং তাদের মধ্যে ৭ হাজার ৫১১ জন মারা যায় যার শতকরা হিসাব দাঁড়ায় ১.৭৫%! মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে তা অল্প হলেও যার যায় তার কিন্তু পুরো পৃথিবীই মাটির নিচে চলে যায়। তাই মৃত্যুর হিসাবে ১ টি প্রাণও অনেক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণায় দেখা যায়, সাপের কামড়ের সব ঘটনার মধ্যে এক চতুর্থাংশ বিষাক্ত অর্থাৎ মাত্র ২৫%। আবার বিষাক্ত সাপের সব কামড়ও বিষাক্ত নয়।
এতে স্পষ্টত দেখা যায় যে, সাপের কামড়ের কমপক্ষে ৭৫% অবিষাক্ত বা এই কামড়ে মৃত্যুর বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেই।
আবার সাপের কামড়ের মধ্যে ৯৫ শতাংশ ভুক্তভোগী গ্রামীণ অঞ্চলের। গ্রামীণ অঞ্চলের এই সহজ সরল মানুষ গুলোর অধিকাংশই আবার ঝাড় ফুঁক, পানি পড়া বা কবিরাজি চিকিৎসায় ব্যাপক হারে বিশ্বাস করে। গ্রামের ছেলে হিসেবে আমার এটা ভালো করেই জানা যে, সেই বিশ্বাসের গভীরতা তাদের অস্থিমজ্জা পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই বিশ্বাস বর্তমান বিজ্ঞান , চিকিৎসা ব্যবস্থা বা মিডিয়ার প্রচারণায় একটুও কমেনি।
ঝাড় ফুঁক কবিরাজি চিকিৎসার জালিয়াতি ও আমাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস
মানুষের সেই সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে অনেকেই ওঁঝা সেজে সাপের বিষ নামান। নির্বিষ সাপ কামড় দিলে যদি সাপের ওঝার কাছে যাওয়া হয় তবে ওঝা বিভিন্ন মন্ত্রপাঠ করে বিষ নামানোর চেষ্টা করেন আর কিছুক্ষণ পর রোগি সুস্থ হয়ে উঠে, এটা দেখে মানুষ ভাবে সাপের ওঝা সাপের বিষ নামাতে পারে।
অথচ, উপরিউক্ত তথ্যের মাধ্যমে জেনেছেন যে কমপক্ষে ৭৫% সাপের কামড় হলো নির্বিষ সাপ! এই ৭৫% মানুষের মৃত্যু কেন, তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হওয়ারই কোন সম্ভাবনা নেই। এখন কবিরাজ কিন্তু প্রচারণা ঠিকই চালায় যে, জীবন ভর বিষ নামায়ে দিলাম। তারা বলে বেড়ায়, বিষ নামানোর পরে অমুকে তমুকে কত শত লোক এখনো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে আর সাধারণ মানুষও তাই মানে ও বিশ্বাস করে। অথচ এখানেই কত ভুল। তথ্য মতে, ১০০ জন মানুষকে সাপে কামড়ালে মিনিমাম ৭৫% মানুষের কিছুই হবে না। সেটা ঝাড় ফুঁক দিল , পানি পড়া খেল বা বুড়িগঙ্গার নদীর বিষাক্ত পানি খেল তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেকে বলতেও পারে না যে আসলে সাপ নাকি ভিন্ন কিছু কামড় দিয়েছে! সাপের কামড় বুঝলেও জানে না যে কোন সাপ কামড় দিয়েছে! সাপ তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা যায় না ; আবার ধরা গেলেও বুঝা কঠিন যে ,সেই সাপ বিষাক্ত নাকি অবিষাক্ত। তাই কনফিউশান তৈরি হয়। আমি জানি না যে, আমি আসলে কোন ভাগে? ৭৫% নাকি ২৫%! আবার ২৫% হলেও জানি না যে আমি কি ১.৭৫% নাকি ৯৮.২৫% গ্রুপে? কে সাপের কামড়ে বেঁচে আছে ,সেসব ডাটা আমার কোন কাজেই আসবে না যদি আমি মরে যাই। যে মরে যাবে তার মা-বাবাকে কি তাবত দুনিয়া দান করেও কিছু বুঝানো যাবে!! যে মারা যাবে তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কি অন্য কেউ বিনির্মাণের দায়িত্ব নিবে? অসহায় এতিম ছেলে-ছেলে-মেয়ের মুখে কি কেউ অন্ন তুলে দেবে!!
সাপে কাঁটার লক্ষ্মণ
সাপে কাঁটার লক্ষ্মণ সমূহ বিভিন্ন রকম। আর এই লক্ষ্মণ গুলো মূলত নির্ভর করে কোন ধরনের সাপ কামড় দিয়েছে তার উপর। সাপ বিভিন্ন ভাবে বিষ ছড়ায়। কেউ স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে, কেউ বা রক্তের মাধ্যমে , কেউ বা সরাসরি হ্নদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করব আবার কেউ বা মাংসের মাধ্যমে বিষ ছড়ায়। অতি পরিচিত কেউটে, গোখরো জাতীয় সাপ স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে বিষ ছড়ায়। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত দ্রুত বিষ ছড়ায় তাই লক্ষ্মণের আশায় বসে না থেকে সাপে কামড়ানোর সাথে সাথেই কাল বিলম্ব না করে নিম্ন বর্ণিত পদ্ধতিতে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে..
সাপে কাটলে করণীয়
- প্রথম ও মূল কথা হলো প্রাথমিক সেবার নামে কোনোভাবেই সময় নষ্ট করা যাবে না। লক্ষ্মণের আশায় বসে থেকে অহেতুক ঝুঁকি বাড়াবেন না। নিকের জীবনকে লটারির টিকিট বানাবেন না।
- সব সাপই বিষাক্ত নয় আবার বিষাক্ত সাপের সব কামড়ও কিন্তু বিষাক্ত নয়। তাই আতংকিত না হয়ে, কোন কুসংস্কারের বশবর্তী না হয়ে প্রয়োজন দ্রুত চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
- দংশন করা স্থান থেকে ভিতরের দিকে সাথে সাথে গামছা বা কাপড় দিয়ে কেবল একটি গিঁট (পায়ে দংশন করলে রানে, হাতে দংশন করলে কনুইয়ের উপরে) এমনভাবে দিতে হবে যেন খুব আটসাঁট বা ঢিলে কোনটাই না হয় (একটি আঙুল একটু চেষ্টায় ভেতরে যেতে পারে)
- দংশিত স্থান কাঁটা ছেড়া না করে কেবল ভেজা কাপড় দিয়ে কিংবা জীবাণুনাশক লোশন দিয়ে ক্ষতস্থান মুছে দেবেন।
- সাপে কাঁটার সাথে সাথেই লক্ষ্মণ প্রকাশের আশায় বসে না থেকে, কোন ঝাঁড় ফুক করে সময় নষ্ট না করে অতি দ্রুত নিজ নিজ জেলা সদর হাসপাতাল বা নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলে যেতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে এন্টি ভেনম যেমন পাওয়া যায় না তেমনি চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সব সাপোর্টও পাওয়া সম্ভব নয় তাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলেও সময় নষ্ট হবে। মনে রাখবেন, সাপে কাঁটার পর হতে প্রতিটি সেকেন্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- অযথা সাপে কাটার স্থান বেশি নড়াচড়া করা যাবে না। স্থানান্তরের সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাঁটতে দেয়া যাবে না। কারণ মাংস পেশির যত নড়াচড়া হবে বিষ তত দ্রুত ছড়াবে।
- সম্ভব হলে সাপের প্রজাতি ও বিষধর কিনা তা নিরূপণের জন্য সাথে নিতে হবে। সাপ পরিবহনে খেয়াল রাখতে হবে, সাপটি মৃত নাকি মরে যাওয়ার ভান করে আছে।
চিকিৎসা
- আপনার দায়িত্ব শুধু সময় মত উপযুক্ত জায়গায় পৌছানো আর বাকিটা চিকিৎসকের ওপর।
- নির্ধারিত পন্থায় পলিভ্যালেন্ট এন্টি ভেনম দিতে হবে।
- তা ছাড়া লক্ষ্মণ ও তার তীব্রতার মাত্রা, সাপের ধরণ এবং রোগীর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে রোগীকে চিকিৎসা দিত হবে।
- দেশের হিসাবে আমি আপনি ১ জন নাগরিক মাত্র কিন্তু সংসারে কিন্তু আমি আপনিই যার যার সংসারের পুরো পৃথিবী। আমি আপনি কেউই কিন্তু আদৌ জানি না যে কে আসলে কোন গ্রুপে পড়বে? কিন্তু মৃত্যুর ঝুঁকি কিন্তু যার যার জন্য শতভাগ আর দেশের হিসাবে মাত্র ১টা মানুষ। তাই যার ঝাড়ে যাবে তার পুরো পৃথিবীই চলে যাবে।তাই প্রয়োজন একটু খানি সচেতনতা। প্রয়োজন অতীতের মত কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাদ দিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণ করা।
চিকিৎসা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
সাপে কামড়ায় গ্রামে কিন্তু চিকিৎসা হয় শহরে। এটাই সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হল, দেশে এন্টিভেনম উৎপাদন হয় না। ইহা রপ্তানি করতে হয়। দামও বেশ। উপজেলা হাসপাতাল গুলোতে রেখে দিয়ে দেখা গেছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডেট এক্সপায়ার হয়ে গেছে। আর স্থানীয় ফার্মেসী গুলোও ডেট এক্সপায়ারের ভয়ে ফার্মেসিতে রাখে না।
সবচেয়ে বড় কারণ হলো, বিষাক্ত সাপের কামড়ে রোগিদের বাঁচাতে হলে শুধুমাত্র এন্টি ভেনমই যথেষ্ট নয়। অনেক ক্ষেত্রেই যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে এবং ক্ষেত্র বেধে মেডিসিন সহ নিউররোলজিস্ট, কার্ডিওলজিস্ট, হেমাটোলজিস্ট এবং নেফ্রোলজিস্ট সহ বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ মতামত এমনকি বোর্ড বসানোরও প্রয়োজন পড়তে পারে। প্রয়োজন হতে পারে HDU, ICU বা CCU সেবার। তাই ঝুঁকিমুক্ত চিকিৎসার অংশ হিসাবেই আপনাকে কমপক্ষে সদর হাসপাতালে যেতেই হবে। তাই আমরা যতই বলি না কেন, উপজেলায় কেন এন্টি ভেনম পাওয়া যায় না, আসলে উত্তর হল যে উপজেলা লেভেলে এন্টিভেনম সাপ্লাই দিয়েও খুব বেশি কিছু করার মত কিছু এই মুহুর্তে সম্ভব নয়।
তবে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে যে, অবিষাক্ত সাপের কারণেও কিন্তু অতিরিক্ত ভয়ে রোগীর ভেসোভ্যাগাল শক বা হার্ট এট্যাক হয়েও রোগী খারাপ হয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
উপসংহার
মূল কথা, ভয়কে জয় করুন। কুসংস্কারকে লাথি মারুন। ওঁঝাকে , ঝাড় ফুঁক কে না বলুন। নিকের জীবনকে লটারির সামগ্রী বানাবেন না। নিজের বা নিজের আপনজনের জীবন নিয়ে অহেতুক ঝুঁকি নিবেন না। সাপে কামড়ানোর সাথে সাথেই সময় ক্ষেপণ না করে অতি দ্রুত নিজ নিজ জেলার সদর হাসপাতাল বা নিকটস্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করুন। নির্বিষ সাপ হলে ডাক্তার আপনাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন আর বিষাক্ত সাপ হলে ভর্তি করে দ্রুত এন্টি ভেনমসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি, যাদের উপযুক্ত জায়গায় পাঠিয়েছি তাদের প্রত্যেকেই সুস্থ আছেন। তাই জীবনকে অহেতুক ঝুঁকিতে না ফেলে ঝুঁকি এড়িয়ে সুস্থ থাকুন। নিজে হাসি খুশি থাকুন আর পরিবার পরিজনকে হাসি খুশি রাখুন।
লেখক : এমবিবিএস বিসিএস (স্বাস্থ্য) এমডি, (নেফ্রোলজি) এমএসিপি (ইউএসএ)। কিডনি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।
আরও পড়ুন:
যুক্তরাজ্যে ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন ইনজেকশন উদ্ভাবন