মো. মিজানুর রহমান, এফসিএস :
স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘদিন যাবৎ কতিপয় আর্থিক নিরীক্ষক বা অডিটর, ফাইন্যান্সিয়াল অডিটে নামে-বেনামে অডিট রিপোর্ট দিয়ে সিএ প্রফেশনকে বিতর্কের মধ্যে ফেলা ৯ নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে আইসিএবি। ফলে এখন অডিট ফার্মের প্রতি সবার আস্থা ফিরে আসবে ।
নিঃসন্দেহে আইসিএবির বর্তমান কাউন্সিলের এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। ধন্যবাদ জানাই আইসিএবির বর্তমান কাউন্সিলকে পেশাগত দক্ষতায় সিএ প্রফেশনকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য। অনেক কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যাক্তিরা ব্যাংক লোনের জন্য মোটাতাজা করা অডিট রিপোর্ট, ইনকাম ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য রুগ্ন অডিট রিপোর্ট আর প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে একচুয়্যাল অডিট রিপোর্ট নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী বানিয়ে নিতেন। ফলে ব্যাংক লোনের জন্য জমা দেওয়া অডিট রিপোর্টে ছিলোনা ব্যাংকের আস্থা। ইনকাম ট্যাক্সে জমা দেওয়া অডিট রিপোর্ট আমলে নিতেন না ‘ডিসিটি’ বা আয়কর কর্তৃপক্ষ। আবার মালিকপক্ষের মধ্যেও অডিট রিপোর্ট নিয়ে মাঝে মধ্যেই মত বিরোধ দেখা দিত। কারন এসব অডিট রিপোর্ট কিনতে পাওয়া যেত।
আইসিএবি ও বিভিন্ন গনমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার ক্ষেত্রে পেশাগত অসদাচরণ, নিরীক্ষার ওয়ার্কিং পেপার নথি সরবরাহ না করা, নিরীক্ষা নথি সংরক্ষণ না করা, ওয়ার্কিং পেপারে পর্যাপ্ত ও যথাযথ নিরীক্ষা দলিলাদি সংরক্ষণ না করা, নিরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জনবল না থাকা, গ্রাহক ও নিরীক্ষকের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে লিখিত সম্মতিপত্র, নিয়োগপত্র ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক দলিলাদি যথাযথভাবে সম্পন্ন না করা, আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে নিরীক্ষা না করা এবং নিরীক্ষা ফির ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) নির্ধারিত তালিকা অনুসরণ না করার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে নয়জন নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে। এ কারণে সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে আইসিএবি কাউন্সিল।
আর্থিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত একাটি কথা আছে, যাকে বলা হয় উইন্ডো ড্রেসিং। দীর্ঘ প্রায় ৩৫-৪০ বছর ধরে এই উইন্ডো ড্রেসিং অডিট রিপোর্ট দ্বারা সামজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের মননশীলতার অবক্ষয় ঘটেছে এ সকল চ্যাটার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্টস এর কারনে।
সম্প্রতি আইসিএবি ‘ডিভিএস’ সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে অডিট রিপোর্ট এ ডাটা ভেরিফিকেশন সার্ভিস চালু করার কারনে বর্ণিত ৯ জন নিরীক্ষক বেকায়দায় পড়েন। মূলত তারা শুধু মাত্র অডিট রিপোর্টে স্বাক্ষর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে অডিট রিপোর্টে জালিয়াতি এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা অভিযোগ থাকলেও বিভিন্ন অযুহাতে এতোদিন পার পেয়ে গেছেন। যার দ্বায়ভার বহন করেছেন পুরো সিএ প্রফেশন বা আইসিএবি।
যে নয় জন নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তারা হলেন- মতিন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের অংশীদার এ কে আব্দুল মতিন এফসিএ, নিতাই চাঁদ তালুকদার এফসিএ ও মো. লিয়াকত আলী খান এফসিএ। আনিসুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের মালিক মো. আনিসুর রহমান এফসিএ, মোহাম্মদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানি চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের মালিক এএসএম আতাউল করিম এফসিএ ও ইমরুল কায়েস এফসিএ। এমএন ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের মালিক নজরুল ইসলাম এফসিএ এবং মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মালিক এএইচ মোস্তফা কামাল এফসিএ।
এ কে আব্দুল মতিনের নিরীক্ষা সনদ ও সদস্যপদ পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা জরিমানা, নিতাই চাঁদ তালুকদারের সনদ ও সদস্যপদ চার বছর স্থগিতের পাশাপাশি ৪ লাখ টাকা জরিমানা ও মো. লিয়াকত আলী খানের সনদ ও সদস্যপদ তিন বছরের জন্য স্থগিত ও ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইভাবে মো. আনিসুর রহমানের সনদ ও সদস্যপদ তিন বছরের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এএসএম আতাউল করিমের সনদ ও সদস্যপদ পাঁচ বছরের জন্য স্থগিতের পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে, ইমরুল কায়েসের সনদ ও সদস্যপদ স্থগিতের পরিবর্তে তাকে তিরস্কার করা হয়েছে। মো. হাফিজ আহমেদের সনদ ও সদস্যপদ পাঁচ বছরের জন্য স্থগিতের পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। নজরুল ইসলামের সনদ ও সদস্যপদ পাঁচ বছরের জন্য স্থগিত রাখার পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এএইচ মোস্তফা কামালের সনদ ও সদস্যপদ তিন বছরের জন্য স্থগিত রাখার পাশাপাশি ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, জরিমানার অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এ নয় নিরীক্ষকের সনদ ও সদস্যপদ আরোও এক বছরের জন্য স্থগিত থাকবে।
জানা গেছে, আরও ৪০/৪৫ টি সিএ ফার্ম আইসিএবির নজরদারিতে রয়েছে । যেকোন সময় তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত করেছে।
আর্থিক নিরীক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরলেও বর্তমানে কম্প্লায়েন্স অডিটে চলছে সার্টিফিকেট বেচা-কেনা। নাম মাত্র ফিতে এখন অনেক অডিট ফার্ম কম্প্লায়েন্স অডিট সার্টিফিকেট দিচ্ছে। আবার কতিপয় নিরীক্ষক আর্থিক নিরীক্ষার সাথে তাদের সহযোগি অডিট ফার্ম দ্বারা কম্প্লায়েন্স অডিট করিয়ে একটার সাথে আরেকটা ফ্রি দিচ্ছেন।
আর্থিক নিরীক্ষায় শুধুমাত্র সিএ প্রফেশন কাজ করায় দেরিতে হলেও এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফেরানো গেছে । কম্প্লায়েন্স অডিটে সিএ, সিএমএ এবং সিএস এই তিন প্রফেশনের কাজ করার সুযোগ থাকায় কোন ইনস্টিটিউটই কম্প্লায়েন্স অডিটে রেগুলেটরের ভুমিকাা পালন করতে পারছেনা। ফলে নিরীক্ষায় বিতর্কের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে কম্প্লায়েন্স অডিট।
সুতরাং দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এফআরসি বা ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল এবং সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসির বর্তমান কমিশনের প্রতি, যেন সিএ, সিএমএ এবং সিএস এই তিনটি প্রফেশনের ইনস্টিটিউট প্রফেশনালদের কাজের জবাবদিহীতা পৃথকভাবে তৈরী হয় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে। এক্ষেত্রে ফাইন্যান্সিয়াল অডিট যেমন সিএ ইনস্টিটিউট দেখছে তেমনি কস্ট অডিট সিএমএ ইনস্টিটিউট এবং কম্প্লায়েন্স অডিট চাটার্ড সেক্রেটারি বা সিএস ইন্সটিটিউট দ্বারা রেগুলেট করার মাধ্যমে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে জবাবদিহীতার আওতায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে কম্প্লায়েন্স অডিটেও একটা সময় কারো কোন আস্থা থাকবেনা। অতএব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফাইন্যান্সিয়াল অডিটের মত কম্প্লায়েন্স অডিটেও একক রেগুলেটরের ব্যবস্থা করবেন এমনটাই প্রত্যাশা কর্পোরেট প্রফেশনালদের।
লেখক: সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ।