চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: একই দলিলের পৃষ্টা নম্বর, তফশীল, দলিল লেখক, স্বাক্ষী ও সনাক্তকারীর নাম হুবহু রেখে গ্রহীতার স্থলে নাম উলট পালট করে জাল জালিয়াতি করে কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগে খালেদা বেগম (৫৭) নামে এক নারী আদালতে মামলা দায়ের করেন অন্য একটি পরিবারের ৮ সদস্যের বিরুদ্ধে।
অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণার আশ্রয়ে জাল দলিল সৃজন করে সেখানে স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের জায়গায় স্বামী মোঃ মহসীনের নাম বসিয়ে কর্ণফুলী উপজেলার ইছানগর এলাকার মৃত শাহজান কবির প্রকাশ রফু মেম্বারের ১০ গন্ডা জমি গ্রাস করার অপচেষ্টায় যুক্ত বলে জানিয়েছেন মামলার বাদি।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্টোর পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মেজাম্মেল হক ওই নারী অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন বলে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ করেছেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোর ইনচার্জ পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। যার সিআর মামলা নং-২৭৬/২২ (কর্ণফুলী)। মামলার বাদি কর্ণফুলীর ইছানগর (৯নং ওয়ার্ড) গ্রামের খালেদা বেগম (৫৭)। স্বামী মৃত শাহজান কবির প্রকাশ রফু মেম্বার। পরে বাদির মৃত্যুবরণে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন কণ্যা দিলোয়ারা খাতুন খুশি (৪৫)।
মামলায় অভিযুক্তরা হলেন-আহমেদ আসাদুল আমিন (৩৮), আহমদ আফজল আরিফ (৫১), আহমদ আফজল আসিফ(৪১), হোসনে আরা বেগম স্বামী মৃত মোঃ মহসীন (৬৬), আফসানা তসনীম (৪৪), হোমায়রা মাখতুম (৪২), মুনিরা সালমা বিল(৩৭), আতেকা আওয়ালা (৩০)। এরা সকলের পিতা মৃত মোঃ মহসীন। বর্তমানে এরা চট্টগ্রাম সদরঘাট থানাধীন ফিরিঙ্গীবাজার এলাকার বাসিন্দা বলে মামলা সুত্রে জানা যায়।
তদন্তে ভুক্তভোগী বাদির সব অভিযোগের সত্যতা পান পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা। এরপর গত ২১ ডিসেম্বর এডিশনাল চীফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জাল জালিয়াতির ধারায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন পিবিআই। সেখানে অভিযুক্ত পরিবারের মা-ছেলেসহ ৭ জন জাল জালিয়াতি কাজে জড়িত বলে দোষী উল্লেখ করা হয়েছে।
পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে জানান, ‘বাদি-বিবাদীরা পরস্পর আত্বীয় হন। বিগত ১৯৮৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পটিয়া সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে ৫২১০ নম্বর বিনিময় পত্র দলিল মূলে এবং সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের বিগত ১৯৮৭ সালের ২৫ জানুয়ারি তারিখে ৮০২ সাব কবলামূলে ইছানগরে ভোগ দখলীয় জমির মালিক হন শাহাজান কবির প্রকাশ রফু মেম্বার। তাঁর মূত্যুতে এক স্ত্রী খালেদা বেগম (বর্তমানে মৃত) ও পাঁচ কণ্যা ও এক পুত্র ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হন।
অপরদিকে, জনৈক মৌলভী জহুর আহমদ ও অলি আহম্মদের পিতা মৃত রহমান আলী কতৃক হোসনে আরা বেগমকে বিগত ১৯৮৭ সালের ১০ আগষ্ট সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে রেজিষ্ট্রিকৃত ৫৫৮১ নম্বর কবলা দেন। যে জমির বর্ণনায় ছিল ইছানগর মৌজার আর.এস ১১৪ খতিয়ানের আর.এস ২১২ দাগের আন্দর ২০ শতক বা ১০ গন্ডা জমি। বর্তমানে যার দাম (আনুমানিক) এক কোটি টাকা প্রায়। যে জমির দখলে আছেন খালেদা বেগম ও তার ওয়ারিশগণ।
ওদিকে, দীর্ঘ ৩০ বছর পর গত বছরের ২৭ মার্চ কর্ণফুলী উপজেলা ভূমি অফিসে বিভিন্ন কাগজপত্রসহ ওই ৫৫৮১ দলিলে জাল জালিয়াতি করে দলিল গ্রহীতার জায়গায় মোঃ মহসীনের নাম বসিয়ে খতিয়ান সৃজনের আবেদন করেন আজিম পাড়া এলাকার মোঃ লাল মিয়ার ছেলে মোঃ হারুনুর রশিদ। এই ব্যক্তির মোবাইল ফোনের কল লিস্টে যোগাযোগের তথ্য রয়েছে হোসনে আরা বেগম ও তার ছেলে আসাদুল আমিনের। এমনকি নামজারি আবেদনে মোঃ হারুনুর রশিদের ফোন নম্বর লিখা রয়েছে।
যদিও পিবিআই পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হারুনুর রশিদ জানান, ‘তিনি একজন মাছ ব্যবসায়ি। বিবাদীরা তার পরিচিত। তাঁদের নিকট ১০ গন্ডা জমি ক্রয় করার জন্য (দলিল নং-১৫৫৩) বায়নানামা সম্পাদন করেন। তিনি পিবিআইকে আরো তথ্য দেন, তার অজান্তেই হোসনে আরা বেগম খতিয়ান সৃজনের আবেদনে তার মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার করেছেন।
পরবর্তীতে বিবাদীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বিএস খতিয়ান-৩৪২৪ সৃজন হয়। এরপর শাহেদুর রহমান শাহেদ নামে আরেক ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে ঐ খতিয়ান বাতিল হয়। এতে বিরোধীয় জমিতে বসবাসকারী ব্যক্তিরা হতভম্ব হয়ে মামলা দায়ের করেন। যার তদন্ত ভার পান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্টো অফিস।
পুলিশ সমস্ত কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে এবং সদর রেকর্ড রুমের তথ্যমতে ৫৫৮১ নম্বর দলিলে দাতা হিসেবে মোঃ মহসীনের কোন অস্তিত্ব পায়নি। পিবিআই পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদনে আরো জানিয়েছেন, সৃজিত ৩৪২৪ খতিয়ানটি বাতিল হয়েছে বলে উপজেলা ভূমি অফিস উল্লেখ করলেও দীর্ঘ ৪ মাস পরও সহিমুহুরী নকল সরবরাহ করা খতিয়ানটি এখনো বাতিল হয়নি।
একই ভাবে গ্রহীতা মোছাম্মৎ হোসনে আরা বেগম, দাতা মৌলভী জহুর আহাম্মদ, আলি আহাম্মদ দ্বয়ের নামীয় দলিলটি জাল জালিয়াতির মাধ্যমে আলী আহাম্মদের স্থলে অতিরিক্ত আরেকজন দাতা ছৈয়দ আহাম্মদ এর নাম উল্লেখ করে তফশীল উলট পালট করে বিবাদীরা পরস্পর অপরাধে জড়িয়েছেন। যদিও পিবিআই পুলিশ ৫ নম্বর বিবাদী আফসানা তাসনীম কে দোষী উল্লেখ করেননি। কারণ তিনি শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় অপরাধে জড়িত নয় বলে প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন।
পিবিআই ইন্সপেক্টর মেজাম্মেল হক বলেন, ‘দলিল জাল জালিয়াতির এই অভিযোগ আমরা প্রমাণ করতে পেরেছি বলে প্রতীয়মান হয়। পাশাপাশি তদন্তে বাদির দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাকিটা বিজ্ঞ আদালতের বিষয়।’
অভিযুক্ত হোসনে আরা বেগম বলেন,‘আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি, ‘যারা দলিল জাল করে খতিয়ান করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি।’
বাদির মৃত্যুর পরে এই মামলার স্থলাভিষিক্ত হওয়া তাঁরই কণ্যা দিলোয়ারা খাতুন খুশি (৪৫) এর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করা সম্ভব না হওয়ায় মন্তব্য পাওয়া যায়নি।