মো: মিজানুর রহমান, এফসিএস : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালে আপনার সরকারের সদিচ্ছার ফসল সিএস প্রফেশন। চাটার্ড সেক্রেটারিজ আইন ২০১০ এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ৩য় কপোর্রেট প্রফেশন হিসাবে আইসিএসবি আইনি স্বীকৃতি পায়, সে কারনে আইসিএসবি বর্তমান সরকারের উন্নয়নের একটি সফল দৃষ্টান্ত। যে কারনে সিএস প্রফেশনের সদস্যদের আপনার কাছে প্রত্যাশাও অনেক যা নিয়ে আজকে আমার এই আবেদন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কর্তৃক পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত ৩৮২ টি কোম্পানির এজিএম ও ইজিএমে এজেন্ডা ভিত্তিক ভোটাভুটি নিরীক্ষণের জন্য প্রতিটি তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার নিয়োগের নিদের্শনা দেয়া হয়েছে। যারা এজিএম ও ইজিএম সম্পূর্ণ হওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে হাইব্রিড বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত কোম্পানির এজিএম বা ইজিএম এ সুষ্ঠ ও আইনানুগভাবে ভোটাভুটি সম্পন্ন হয়েছে মর্মে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে রিপোর্ট করবে। সূত্র : ১০ মার্চ ২০২১ বিএসইসি ডাইরেক্টিভ নাম্বার বিএসইসি/সিএমআরআরসিডি/২০০৯-১৯৩/০৮।
এ ক্ষেত্রে ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার হিসেবে কাজ করার জন্য যোগ্যতা দেয়া হয়েছে সিএ এবং সিএস প্রফেশনের প্র্যাকটিসিং সদস্যদের। কিন্তু এজিএম, ইজিএম এবং ফেয়ার ভোটাভুটি পরিপালন ও পর্যবেক্ষণের জন্য পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে শুধুমাত্র চাটার্ড সেক্রেটারি (সিএস) প্রফেশনের সদস্যদের।
আইসিএসবি মহান সংসদে প্রণীত চাটার্ড সেক্রেটারিজ আইন ২০১০ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রফেশনাল বডি। যাদের কাজই হচ্ছে কোম্পানির বোর্ড মিটিং, এজিএম, ইজিএম এবং গুড গর্ভনেন্স ও কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করা। অথচ বিএসইসি সিএ প্রফেশনকেও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার হিসেবে কাজ করার জন্য সুযোগ দিয়ে রেখেছেন।
যারা পিউর একাউন্টিং প্রফেশন নিয়ে কাজ করে। কোন চাটার্ড সেক্রেটারি কিন্তু একাউন্টিং প্রফেশনের নির্ধারিত কোন কাজ করছে না। কিন্তু এখানে বিএসইসি সিএ প্রফেশনকেও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার হিসেবে কাজ করার সুযোগ রেখেছে।
এর আগে, ২০১৮ সালের ৩ জুন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কতৃর্ক ইস্যুকৃত ‘‘কপোর্রেট গর্ভনেন্স কোড ২০১৮’’ তে কপোর্রেট গর্ভনেন্স সার্টিফিকেট ইস্যু করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নিদের্শনা দিয়েছে। প্রতিটি তালিকাভূক্ত কোম্পানিতে কপোর্রেট গর্ভনেন্স প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে চাটার্ড সেক্রেটারি প্রফেশন কিন্তু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এখানেও কপোর্রেট গর্ভনেন্স সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য সিএ, সিএমএ এবং সিএস এই ৩টি প্রফেশনের জন্যই সুযোগ রেখেছেন। ফলে চাটার্ড সেক্রেটারি প্রফেশনের কাজ চাটার্ড সেক্রেটারিরা করার সুযোগ পাচ্ছে না। যে কাজে সিএ, সিএমএ প্রফেশনের কোন এক্সপার্টাইজ নেই, তুলনামুলক কম ফিতে তারা সে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে সিএস প্রফেশনের প্র্যাকটিসিং ফার্মগুলো কাজ পাচ্ছে না। আবার ফাইন্যান্সিয়াল অডিটের ক্ষেত্রে প্রতি ৩ বছর পর পর অডিটর পরিবর্তনের বিধান থাকলেও কমপ্লায়েন্স অডিট বা সার্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে বিএসইসি সে রকম কোন বিধানও রাখেনি। ফলে ২০১২ সাল থেকে অদ্যবধি কোম্পানিগুলো সেই সিএ এবং সিএমএ ফার্ম দিয়ে তুলনামুলক কম প্রফেশনাল ফিতে কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশনের কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। ‘‘কপোর্রেট গর্ভনেন্স কোড ২০১৮’’ তে এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা না থাকায় চাটার্ড সেক্রেটারি এক্ট ২০১০ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সিএস প্র্যাকটিসিং সদস্যরা কোন কাজ পাচ্ছে না।
অন্যদিকে, কপোর্রেট গর্ভনেন্স কোড ২০১৮ তে প্রতিটি লিস্টেড কোম্পানিতে সিএফও, সিএস এবং হেড অব ইন্টারনাল অডিট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু ঐ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন নির্ধারিত যোগ্যতার বিষয়ে উল্লেখ করেনি। ফলে নন-প্রফেশনাল আত্মীয় স্বজনকে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা ঐসব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিচ্ছেন। যে কারনে পুঁজিবাজারের আর্থিক বিবরণীর উপর বিনিয়োগকারীদের কোন আস্থা নেই। এখানেও ৩ প্রফেশনকে নির্ধারিত যোগ্যতার আওতায় আনা যেত কিন্তু তা করেনি।
এখানে উল্লেখিত সকল ক্ষেত্রে লক্ষনীয় যে, কমপ্লায়েন্স অডিট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার হিসেবে বাজারে তালিকাভূক্ত সকল কোম্পানিতে পেশাগত সার্ভিস দেওয়ার জন্য বর্তমানে আইসিএসবি সদস্যভূক্ত পেশাদার ও দক্ষ পর্যাপ্ত সংখ্যক প্র্যাকটিসিং ফার্ম রয়েছে। বিএসইসি সিএস প্র্যাকটিসিং ফার্মকে দিয়ে অনায়াসেই তাদের নিদের্শনা পরিপালনের জন্য কমপ্লায়েন্স অডিট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারতো। যেমনটি করা হয়েছে ৩৮টি প্র্যাকটিসিং ফার্ম দ্বারা ফাইন্যান্সিয়াল অডিটরস প্যানেল। বাংলাদেশে প্রায় দুই শতাধিক সিএ প্র্যাকটিসিং ফার্ম থাকলেও সেখান থেকে ৩৮ টি প্র্যাকটিসিং ফার্মকে দিয়ে বিএসইসি ফাইন্যান্সিয়াল অডিট করিয়ে নিচ্ছে। অথচ কমপ্লায়েন্স অডিট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে সকল প্রফেশনের প্র্যাকটিসিং ফার্মের জন্য নিয়োগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যে কারনে সিএস প্রফেশন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
আইসিএসবি কর্পোরেট সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চাটার্ড সেক্রেটারিজ আইন ২০১০ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্বাধীন পেশা, বিএসইসি বরাবরের মত এবারও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার নিয়োগের ক্ষেত্রে আইসিএসবি সদস্যভূক্ত প্র্যাকটিসিং ফার্মকে প্যানেলভূক্ত করে নিদের্শনা দিতে পারত কিন্তু তারা তা করেনি। ফলে সিএস প্রফেশন সিএ এবং সিএমএ প্রফেশন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে এবং যাদের কাজ তাদের করতে দেওয়া হচ্ছে না।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কেম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল অডিটের জন্য যেমন ৩৮টি ফার্মের সমন্বয়ে একটি অডিট প্যানেল গঠন করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও যদি সিএস প্রফেশনাল সদস্যের ফার্মকেও প্যানেলভূক্ত কমপ্লায়েন্স অডিটর ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার এর তালিকা যদি বিএসইসি কর্তৃক চুড়ান্ত করে দেয়া হয় তাহলে কর্পোরেট সেক্টর এ গুডগভর্নেন্স প্রতিষ্ঠায় এটি একটি মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, কেনিয়া সহ বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কর্পোরেট সু শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার চাটার্ড সেক্রেটারি প্রফেশনের জন্য আলাদা আইন ও প্রফেশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে, যার নাম ইনস্টিটিউট অব চাটার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)। কর্পোরেট সেক্টর তথা পুঁজিবাজারে কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চাটার্ড সেক্রেটারি আইন- ২০১০ বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে ২০১০ সালের ১৬ জুন পাশ হয়। এই ইনস্টিটিউট এর বর্তমান সদস্য সংখা ৫৬৭ যাদের মধ্যে অনেক সদস্যের প্র্যাকটিসিং ফার্ম আছে ফলে জাতীয় সংসদের আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সিএস প্র্যাকটিসিং প্রফেশনালদের কর্পোরেট গুডগভর্নেন্স নিয়ে কাজের ক্ষেত্রটা নির্দিষ্ট করে দিলে বর্তমান সরকারের কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আরো বেশি সুফল বয়ে আনবে।
বর্তমান সরকারের কর্পোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে মহৎ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত আলাদা প্রফেশন এবং ইনস্টিটিউট (আইসিএসবি), শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রকারী কর্তৃপক্ষের ভূমিকার কারণে এর সফল বাস্তবায়ন আশঙ্কাজনকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ চাটার্ড সেক্রেটারি প্রফেশন তথা আইসিএসবি’র সদস্যদের প্র্যাকটিসিং চাটার্ড সেক্রেটারি হিসেবে কর্পোরেট গভর্নেন্স কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেট দেওয়া ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার হিসেবে কাজের ক্ষেত্রটি স্বল্প পরিসরে থেকে যাচ্ছে। সে কারনে বিএসইসি‘র কর্পোরেট গভর্নেন্স কোড, ২০১৮ এর সেকশন ৯ এর সাব সেকশন ১ এ সার্টিফিকেশনের বিষয়টি সংশোধন হওয়া দরকার। এবং একইভাবে ১০/৩/২১ তারিখে দেয়া বিএসইসি কর্তৃক দেওয়া ডাইরেক্টিভ এর সেকশন ৯ সংশোধন হওয়া দরকার কারন রেগুলেটারী কর্তৃপক্ষের উচিত যার কাজ তাকে দিয়ে করানো। তা না হলেত ভিন্ন ভিন্ন প্রফেশনাল বডির উদ্ভব হতো না।
৩৮২টি কোম্পানির এজিএম ও ইজিএম ডিজিটাল প্লাটফর্মে করার জন্য বর্তমানে কাজ করছে হাতে গোনা ৪/৫টি আইটি ফার্ম। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর এজিএম ও ইজিএম করতে তাদের কোন অসুবিধাই হচ্ছে না। একইভাবে বাংলাদেশে বর্তমানে ৮টি ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি রয়েছে যারা ১০ থেকে ১২ হাজার কোম্পানিকে প্রতি বছর ক্রেডিট রেটিং করে থাকে। এত অল্প সংখ্যক আইটি ফার্ম ও ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি যদি সঠিকভাবে তাদের সার্ভিস দিতে পারে তাহলে সিএস প্রফেশনের সদস্যভূক্ত প্র্যাকটিসিং ফার্ম দ্বারাও খুব ভালভাবেই কর্পোরেট গভর্নেন্স কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশন ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজারের কাজ খুব ভালভাবেই করা সম্ভব।
শেয়ার বাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ফাইন্যান্সিয়াল অডিট, কর্পোরেট কমপ্লায়েন্স অডিটের তুলনায় অনেক বেশি বড় একটি ক্ষেত্র এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বিএসইসি’র তালিকাভুক্ত ৩৮টি সিএ ফার্ম দ্বারা যদি ৩৮২ টি কোম্পানির ফাইন্যান্সিয়াল অডিট করা সম্ভব হয় সেক্ষেত্রে এই ৩৮২ টি কোম্পানির কর্পোরেট কমপ্লায়েন্স অডিট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজারের সার্টিফিকেশন বিদ্যমান সিএস সদস্য প্রফেশনাল প্র্যাকটিসিং ফার্ম দিয়েও সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। কর্পোরেট সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। এবং এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার হস্তক্ষেপ খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশে গত ১২ বছরে আপনার হস্তক্ষেপেই চাটার্ড সেক্রেটারি প্রফেশন আইন ২০১০ দ্বারা আইনসিদ্ধ হয়েছে। এবারেও আপনার হস্তক্ষেপ হলে এ পেশায় প্রতিষ্ঠিত সদস্যরা এবং প্র্যাকটিসিং ফার্মগুলো আপনার উন্নয়ন কাজের অংশিদার হওয়ার সুযোগ পাবে, না হলে বরাবরের মত সিএ প্রফেশনই জেনারেল সার্জনের মত সব পেশার কাজে হস্তক্ষেপ করে যাবে। অতএব কর্পোরেট সেক্টরের গুড গর্ভনেন্স প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি কোম্পানিতে কমপ্লায়েন্স সার্টিফিকেশন, সেক্রেটারিয়াল অডিট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্ক্রুটিনাইজার ও আরজেএসসিতে কোম্পানির সকল ধরনের রিটার্ন ফাইলের ক্ষেত্রে চাটার্ড সেক্রেটারি প্রফেশনের সার্টিফিকেট নেয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়ার জন্য আপনার হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি। জয়বাংলা- জয়বঙ্গবন্ধু ও জয়ীহোক আপনার সকল উদ্যোগ।
লেখক: সম্পাদক, কর্পোরেট সংবাদ ; ফেলো, আইসিএসবি ও কলামিস্ট