December 24, 2024 - 12:41 am
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeনির্বাচিত কলামলজ্জাঃ সভ্যতার ঐশ্বর্য

লজ্জাঃ সভ্যতার ঐশ্বর্য

spot_img

আবদুল কাইয়ুম মাসুদ : ৯০ এর দশকের শেষের দিকের ঘটনা। আমার এক বন্ধু তার আত্মীয়ের পিচ্চির সাথে ঘটে যাওয়া খুব মজার এক ঘটনা বর্ণনা করলো। সেটি ছিলো এরকম, ছোট্ট বাবুটির সাথে সে দুষ্টুমির ছলে বলেছিলো, তোমার লজ্জা নেই, পিচ্চিও প্রাণপন চেষ্টা করছে তার লজ্জা আছে সেটা বুঝাবার। কিন্তু পিচ্চি তো পিচ্চিই, বড়দের সাথে কি আর পারে! এক পর্যায়ে সে প্যান্ট খুলবে খুলবে ভাব করছে, কিন্তু খুলছে না। মানে সে বুঝাতে চাইছে, লজ্জা আছে দেখে সে প্যান্ট পরেছে। ৩ বা ৪ বছরের বাচ্চা বুঝেছে প্যান্ট পরে সে লজ্জা ঢেকে রেখেছে। এতোটুকু বয়সে এটুকুই যথেষ্ঠ ছিলো। সেসময় পিচ্চির এ কাহিনি আমাদের হাসির উপলক্ষ হয়েছিলো। আমরা তখন অনার্সের ছাত্র ছিলাম।

ছোট্ট পিচ্চির জন্য লজ্জার আবরণ হিসেবে ছোট্ট একটি প্যান্ট পরার জ্ঞানই যথেষ্ঠ। এরপর মানব সন্তান যতো বড় হতে থাকে ততো এ আবরণের পরিসরও বাড়তে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, খাওয়া-পরা, দেখা-সাক্ষাৎ, আলাপ-আলোচনা, স্নেহ-সম্মান, সৌজন্যতা-ভদ্রতা সর্বোপরি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে লজ্জার আবরণ থাকা বাঞ্চনীয় হয়ে দাঁড়ায়।

লজ্জা ন্যাচারাল একটি বিষয়। সব মানুষেরই লজ্জা থাকে; কারো বেশি, কারো কম। কিশোর বয়স থেকেই শরীরবৃত্তীয় নানা কারণে মানুষের মাঝে লজ্জার বিকাশ হতে থাকে। এই লজ্জাই সভ্যতার আবরণ হিসেবে মানুষকে সুশোভিত করে রাখে। অনৈতিক যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে স্বীয় লজ্জা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি অনেক স্বাভাবিক কাজও চক্ষু লজ্জার ভয়ে অনেককে এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। আবার একই কারণে কাউকে কাউকে অনিচ্ছা সত্বেও অনেক কাজ করতেও দেখা যায়। যেমন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেক মানুষ সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও নানান আচার অনুষ্ঠান করে যেতে দেখা যায়।

এককথায় বলতে গেলে মানুষকে আপনার ভেতর থেকে অনৈতিক, অসামাজিক বা অপরাধমূলক কাজে যেমন বাধা দেয় এ লজ্জা, তেমনি অনেক কল্যাণকর কাজেও তাড়া দেয়। অর্থাৎ লজ্জা যার যতো বেশি, সে ততো পরিশুদ্ধ থাকতে পারে। আবার উল্টো কথাও আছে, যার লজ্জা নেই, সে যে কোনো কিছু করতে পারে।

লজ্জার সঠিক বিকাশ যথাসময়ে হওয়া চাই। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বয়োসন্ধিকালীন খুব সতর্কতার সহিত এক্ষেত্রে বাচ্চাদের সহায়তা করা খুবই জরুরি, পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য বিশেষ করে মা-বাবাকে এটির যথাযথ বিকাশে যেমন লক্ষ্য রাখতে হয় তেমনি লজ্জার কারণে সে যেনো কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সে দিকটাও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাকে শিখিয়ে দিতে হয় কোথায় লজ্জা করবে আর কোথায় সতর্ক হয়ে নিজেকে রক্ষা করবে। এখান থেকেই মূল্যবোধ জাগ্রত হয়।

এখন জেনে নিই, লজ্জা বলতে কী বোঝায়? এটির আরবি প্রতিশব্দ ‘হায়া’ আর ইংরেজি প্রতিশব্দ Shame, Modesty অথবা Inhibition (শালীনতা, সংযম, আত্মপ্রতিরোধ) কিন্তু কোনো ওয়ার্ডই ‘হায়া’র তাৎপর্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয় না। Shame এর বাংলা প্রতিশব্দ হয় লজ্জা/অপমান/গ্লানি। Modesty বলতে বোঝায় অশিষ্ট আচরণ থেকে দূরে থাকা; এক ধরনের নিস্তেজ সংকোচ। Modesty শব্দের বিপরীতার্থক বিশেষণ immodest কখনও কখনও প্রশংসাসূচক Courage অর্থাৎ সাহস বা নির্ভীকতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। Inhibition (সংযম বা আত্মপ্রতিরোধ)-এর শাব্দিক অর্থ হলো, চেতন বা অবচেতন; এক ধরনের অর্ন্তনিহিত যান্ত্রিকতা যা অগ্রহণযোগ্য মানসিক প্রবণতা্র অবদমন করে রাখে। এটি খুবই নিরপেক্ষ একটি সংজ্ঞা। এজন্যই মনোচিকিৎসকরা তাদের রোগীদের ক্ষেত্রে Inhibition বা আত্মপ্রতিরোধকে জয় করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেন।

এই সকল শব্দ বা প্রতিশব্দে কাঙ্ক্ষিত নৈতিক মানে অস্পষ্টতা লক্ষ করা যায়। তবে ‘হায়া’ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে একটি পরম কাঙ্খিত নৈতিক গুণ বুঝায়; যা আমাদেরকে সকল মন্দ,পাপকার্য ও অনৈতিকতা থেকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। কোনো অপরাধকর্মে নিয়োজিত হওয়ার কথা ভাবলেই যেটির প্রভাবে আমরা ভেতরে-ভেতরে কষ্ট ও অস্বস্তি অনুভব করি, সেটিই ‘হায়া’ বা ‘লজ্জা’। এটি মানুষের সহজাত প্রবণতা। ইসলামে ‘হায়া’ বা লজ্জা নৈতিক ব্যঞ্জনাকে পরিস্ফুট করে। মানুষকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :‘প্রত্যেক ধর্মেরই একটি স্বতন্ত্র নৈতিক আহবান আছে, ইসলামের নৈতিক আহবান হলো হায়া’। এ বাণীটি সুনানে ইবনে মাজাহ গ্রন্থে সংকলিত আছে। এ প্রসঙ্গে রাসুল(সঃ) আরও বলেছেন, যা বুখারী, মুসলিম ও তিরমিযি শরীফে সংকলিত হয়েছে…

‘লজ্জাশীলতা পূণ্য ও কল্যাণ ব্যতীত আর কিছুই আনয়ন করে না। অন্য বর্ণনায় আছে লজ্জার সর্বাংশই উত্তম।’
‘ লজ্জা ও অল্প কথা বলা ঈমানের দু’টি শাখা আর অশ্লীলতা ও বাকপটুতা (বাচালতা) মুনাফিকীর দু’টি শাখা।’

উপরে উল্লিখিত বাণী হতে প্রতিয়মান হয় যে, মনুষ্যত্ব ও লজ্জাশীলতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। লজ্জা ভদ্র লোকের ভূষণ আর নির্লজ্জতা মুনাফিকের অস্ত্র। সুতরাং সভ্য নর-নারীর জন্য সেই ভূষণ আঁকড়ে থাকা অপরিহার্য।

উপর্যুক্ত শিক্ষার ভিত্তিতেই ইসলামের স্বর্ণযুগে এক বিস্ময়কর ও বহুমাত্রিক নৈতিক বিপ্লব সাধিত হয়েছিলো, ‘হায়া’ বা লজ্জা ছিলো সেই যুগের ভীত, মহা মূল্যবান ঐশ্বর্য। আজও বিশ্বব্যাপী প্রতি শুক্রবার যে-জুমআর খুতবা প্রদান করা হয় সেখানে এখনো ইসলামের তৃতীয় খলীফা সাইয়্যিদিনা হযরত উসমান (রা:) এর কথা উল্লেখ করা হয়, যিনি ছিলেন সর্বাধিক লজ্জাশীল (আসদাকুহুম হায়া)। ইসলামে ‘হায়া’ লজ্জা অনেক বেশি উচ্চমূল্যে গৃহীত ও অভিনন্দিত হয়।

ইসলামে যে পর্দার বিধান, নারী পুরুষের মেলামেশার ক্ষেত্রে ইসলামের যে বিধিনিষেধ, পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের বিষয়ে ইসলামের যে শিক্ষা, তার সবই হায়া থেকে উৎসারিত।

খেলাফতের পরও শতাব্দীর পর শতাব্দী মুসলিম সমাজে হায়া, লজ্জাশীলতা বা সম্ভ্রমবোধ অক্ষত ছিলো। তিন শতাব্দী আগে মুসলিম দেশগুলো যখন একে একে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ হলো, সেসময় তারা এমন এক সভ্যতার মুখোমুখি হলো, যার সাথে অনেক ক্ষেত্রে হায়া বা লজ্জাশীলতার দ্বন্দ্ব দেখা দিলো। নবাগত পশ্চিমা সভ্যতা কিছু ক্ষেত্রে নৈতিক মানে উন্নীত হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা হায়া বা মুল্যবোধে কুঠারাঘাত করতে থাকে। ফলে উদ্ভুত নির্লজ্জ পরিস্থিতি একসময় বর্বরতায় রূপ নেয়।

বন্দুকের জোরে তাদের যে সামরিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিমসমাজ প্রায় সামষ্টিকভাবে তাদের এতোদিনের লালিত হায়া বা লজ্জাশীলতার ঐশ্বর্য হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকলো। পশ্চিমাদের শক্তিশালী ও প্রলুব্ধকর প্রচার হয়ে উঠল সেই যুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার। প্রথমে বই-পুস্তক, ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্র দিয়ে শুরু; তারপর এলো রেডিও, টেলিভিশন আর এখন ইন্টারনেট। শুরু হলো বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগ আর সাংস্কৃতিক বিনিময়। এক্ষেত্রে কিছু কিছু ভালো দিক যেমন রয়েছে তেমনি অনেকাংশে মানুষের স্বভাবগত লজ্জার খোলস থেকে বের করে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া।

ফলতঃ এমন সব ধারণা ও মনোভাবের প্রসার ঘটাতে থাকলো, যা ‘হায়া’র জন্য খুবই ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। তারা অশ্লীলতাকে করে তুললো হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয়। আর বেহায়াপনার এই গতি অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পেতে থাকলো; যা এখন পূর্ববর্তী সকল সম্মিলিত প্রচারের চেয়েও বহুগুণ ক্ষমতাধর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

এই করুণ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি ও পরিত্রাণ লাভের জন্য আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ‘হায়া’ অর্থাৎ লজ্জাবোধকে যথাযথ বিবেচনায় গ্রহণ করতে হবে। অশ্লীলতার প্রসার যতোই হোক, নিজের ভেতর থেকে তা প্রতিরোধের নৈতিক শক্তি যেনো আগামী প্রজম্ম পায় ‘হায়া’র ভিত্তিতে সে শিক্ষা তাদের দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নৈতিকতা ছাড়া ইসলামী জীবন হয় না; আর ‘হায়া’ ছাড়া ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি মজবুত হয় না। এ কথাটি আমাদের হৃদয়ে গেঁথে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক: প্রভাষক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ
কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজ চট্টগ্রাম।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ

এসকে ট্রিমসের ক্যাটাগরি পরিবর্তন

পুঁজিবাজার ডেস্ক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের শেয়ার ক্যাটাগরি পরিবর্তন করা হয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র...

একমি ল্যাবরেটরিজের ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ অনুমোদন

পুঁজিবাজার ডেস্ক: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত দি একমি ল্যাবরেটরিজ লিঃ এর ৪৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১১টায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত হয়। সভায়...

খাইতে খাইতে শেখ মুজিবরেও খেয়ে ফেলেছে: বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম বলেন, স্বাধীনতার পরে পল্টন ময়দানে মওলানা ভাষানী শেখ মুজিবুর রহমানকে...

দেশব্যাপী গ্রাহক সেবা সপ্তাহ-২০২৪ শুরু করলো ওয়ালটন কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট

কর্পোরেট ডেস্ক: ‘সেবার প্রত্যয়ে আমরাই এগিয়ে’ এই স্লোগানে দেশব্যাপী ‘গ্রাহক সেবা সপ্তাহ- ২০২৪’ কর্মসূচী শুরু করেছে দেশের টেক জায়ান্ট ওয়ালটনের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট (সিএসএম)।...

‘ঐতিহ্য’-এর নতুন উদ্যোগ: ‘বিনামূল্যে বই নিন, বই পড়ে ফেরত দিন’

কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক: প্রকাশনা সংস্থা 'ঐতিহ্য' দীর্ঘদিন ধরে পাঠকদের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়তে এবং সাহিত্যের চর্চাকে উৎসাহিত করতে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।...

চুয়াডাঙ্গায় আনসার-ভিডিপি সদস্যের মাঝে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ

আহসান আলম, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গায় আনসার ও ভিডিপির সদস্যদের মধ্যে শীতবস্ত্র (কম্বল) বিতরণ করা হয়েছে। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বেলা ১২টার দিকে সদর উপজেলার আলুকদিয়া...

সাবেক এমপি হেনরী ও তার স্বামীর ব্যাংক হিসাবে ২৩০০ কোটি টাকার লেনদেন

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: প্রায় ৭৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদারের নামে...

শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারতকে ঢাকার চিঠি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

কর্পোরেট সংবাদ ডেস্ক : গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠাতে ভারত সরকারের কাছে একটি কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়েছে...