মোঃ আলীমুজ্জামান : আইনের ব্যাসিক অর্থ বলতে কি বোঝায়, এটা নিয়ে আপনারা অনেক ইতিহাস টেনে আনতে পারবেন। আমরা আইন বলতে যা বুঝি সেটা হল ”আইন একটা কাঠের ফ্রেম, যে যত সুন্দর ভাবে ডেকোরেশন করতে পারবে সে তত সুবিধা নিতে পারবে। আইন হল বোঝা ও বোঝানোর বিষয়। যে যত ভাল বুঝবেন সে তত ভাল বোঝাতে পারবেন। যদি সেটা না হত তবে আইন উপস্থাপনের মাধ্যমে ফাসির আসামী খালাস পেত না আবার নির্দোশ ব্যাক্তির ফাসি হত না। বিচারক যখন বিচার করেন তখন লাশ ও থাকে না অন্য দিকে আসামীর হাতেও মারার আলামত থাকে না । শুধু থাকে ঐ সময়কার লিখিত কিছু দলিলাদি ও সাক্ষি হিসাবে কিছু মানুষ। সে সমস্ত দলিলাদির দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন এর একটু এদিক সেদিক হয়ে গেলে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে সম্পূর্ণ মোটিভ।
আইন ও আইনের ভাষা সেটার একটা বৈশিষ্ট্য থাকবে। সেটার পরিবর্তন করতে না পারলেও সেটার ব্যবহার জানা থাকলে, সেটার সুবিধা নেওয়া যায়। আমরা সবাইকে বলি আইনের সুবিধা পেতে, আগে এর আওতায় আসতে হবে। ভ্যাট আইন ও উপরোক্ত সকল বৈশিষ্ট্য দ্বারা তৈরী আইন। ঘটনা কেন ঘটল সেটার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় কিভাবে সমাধান করা যায়। উৎসে ভ্যাট কর্তন, ভ্যাট আইনের সামান্য একটা অংশ। এর ব্যবহার ও ব্যাপ্তি অনেক বড় পরিসরে।
উৎসে ভ্যাট কর্তন নতুন কোন বিষয় না, যা মাত্র এক অর্থবছর ২০১৯-২০ সালের আইনে ছিল না। পূর্বের ভ্যাট আইনে ও উৎসে ভ্যাট কর্তনের বিকালতা ছিল। পৃথিবীর যে সকল দেশে ভ্যাট আইন প্রচলিত আছে, সে সকল দেশের মধ্যে স্নেন ও আফ্রিকার কিছু দেশ ছাড়া অন্য কোন দেশে উৎসে ভ্যাট কর্তনের বিধানের প্রচলন নাই। এটা ভ্যাট ব্যবস্থাপনার একটা দূর্বল দিক হলে ও ভ্যাট আদায়ের একটা নিরাপদ ব্যবস্থা। আমাদের দেশে মোট ভ্যাট আদায়ের ৪০-৪৫% ভ্যাট উৎসে আদায় থেকে হয়। ভ্যাট আইন ২০১২, কার্যকর ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎসে কর্তনের আলাদা কোন তালিকা ছিল না। চলতি অর্থবছরে সর্বমোট ৪৩ টি সেবার তালিকাও পার্শ্বে বর্নিত হারে উৎসে কর্তন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং সেখানে ট্রেজারী জমা প্রদানের কথা বলা আছে। পূর্বে ১৫% হারে মূসক চালান ৬.৩ থাকলে উৎসে কর্তন করা যাবে না বলা থাকলে এবার কিছু ক্ষেত্রে ১৫% হারে থাকলে উৎসে কর্তন করতে হবে। বিষয়টা যুক্তিযুক্ত কারণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল রেস্তোরা, ডেকোরেটর, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ভ্যাট সহ টাকা সংগ্রহ করলে ও সেটা পরিশোধ করার নিশ্চয়তা থাকে না। অন্য দিকে কোন পণ্য সরবরাহকারী ১৫% হারে মূসক চালান ৬.৩ ইস্যু করে পন্য সরবরাহ করলে উৎসে মূসক কর্তন না করার কথা বলা আছে। যদিও তালিকায় সরবরাহকারীর হার ৭.৫% বলা আছে। উৎসে কর্তনের বিকল্প কোন পদ্ধতি আসলে নাই সেটা বিগত অর্থ বছরের ভ্যাট আদায়ের পরিস্থিতি দেখলে বোঝা যায়।
যদি কোন ব্যবসায়ী পন্য ক্রয় ও সরবরাহ করেন এবং তিনি ১৫% হারে ভ্যাটের আওতায় এসে রিয়াত গ্রহন করেন এবং উনার মূল্য সংযোজন সহ বিক্রির সময় ১৫% হারে ৬.৩ ইস্যু করেন তাহলে তালিকায় থাকলেও উৎসে কর্তনের ব্যাতিক্রম হিসাবে ব্যবসায়ীদের আদর্শ ভ্যাট হারে আসার উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। সরকারের ভ্যাট ব্যবস্থাপনা উন্নত দেশের আদলে করার সদিচ্ছা থাকলে ও ব্যবসায়ীগণ সেটা ধরে রাখতে পারেন নাই। মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে অভ্যন্তরীন সম্পদ আহোরণ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হওয়ায় এবং সেটা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে উৎসে ভ্যাট কর্তনের বিধি বিধান সংযোজন করা হয়েছে। তবে ভ্যাট আইনে উৎসে কর্তনের যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে, সেটা শুধুমাত্র যাদের নিকট থেকে উৎসে কর্তন করা হবে তাদের জন্য, কর্তনকারী তার খরচ সমূহ হিসাবভূক্ত করার ক্ষেত্রে তৈরী জটিলতা বিবেচনা আনা হয় নাই। অবশ্য কোন আইন প্রনয়ণে যাদের উপর প্রয়োগ করা হবে সেটা সঠিকভাবে করতে পারলে ব্যবহার সে অনুসারে হয়ে থাকে। ভ্যাট আইনের ব্যবহারিক যে জটিলতা সেটা তৈরী হয় ফিল্ড লেভেলে কম ভ্যাট প্রদান বা আদায়কারীর ব্যক্তি সুবিধা প্রাপ্তির আশা থেকে। বর্তমান উৎসে ভ্যাট কর্তন ও এর ব্যাতিক্রম হবে না। আমরা উৎসে মূসক কর্তনে যে সকল জায়গায় ব্যবহারিক জটিলতা তৈরী হয় সেগুলো ও সেভাবে ভ্যাট আদায় করলে পণ্য মূল্যের উপর প্রভাব বিস্তার করবে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত ভাবে বলার চেষ্টা করব।
সেবার তালিকায় কিছু সেবা আছে যে গুলোর সাথে কোন পন্য বা সেবায় অন্য কিছুর সংযোগ নাই। যেমন কন্সালটেন্সী ফি, এ্যাকাউন্টিং ও অডিট ফার্মের ফি ইত্যাদির উপর সরাসরি প্রযোজ্য হারে উৎসে কর্তনকারীর হিসাবে প্রর্দশিত খরচের সাথে মিল থাকে বলে সেগুলো ব্যবহারিক কোন ঝামেলা তৈরী হবে না। যে সমস্ত সেবা প্রদান করতে পন্য বা অন্য প্রকার উপকরণ ব্যবহার করা হয় এবং সরাসরি সেবায় সংশ্লিষ্টদের বেশীর অর্থ পরিশোধ করতে হয়, সেক্ষেত্রে উৎসে কর্তনকারীর হিসাবে প্রর্দশিত খরচের সাথে কর্তনকৃত ভ্যাটের মিল থাকবে না। যেমন মানব সম্পদ সরবরাহকারীর উপর ১৫% হারে উৎসে ভ্যাট কর্তনের কথা বলা আছে। যিনি মানব সম্পদ সরবরাহের ব্যবসায় থেকে তার আয় বা সমস্ত পরিশোধিত মূল্যের মধ্যে তার অংশের উপর এ হার কার্যকর হবে। এ ধরনের ব্যবসায় বিলের বেশীর ভাগ অংশ প্রদান করা হয় যাদের সরবরাহের মাধ্যমে বিলের মোট টাকা প্রাপ্য হয়েছে।অন্যদিকে মোট টাকা খরচ হিসাবে না আনলে প্রকৃত লাভ/লোকসান নিরুপিত হবে না।
ধরা যাক একজন ব্যবসায়ী বাৎসরিক ১০ লক্ষ টাকা লেবার বিল হিসাবে খরচ দেখালেন। স্বাভাবিক নিয়মে ভ্যাট অফিসার সম্পূর্ণ খরচ ভ্যাট সহ ধরে ১৫% ১.৩০ লক্ষ টাকা উৎসে কর্তনের ভ্যাট দাবী করবেন। প্রকৃতপক্ষে সর্বমোট বিলের ১০% ছিল সরবরাহকারীর কমিশন এবং সেটার উপর ১৫% হারে ১৩.০৩ হাজার টাকা উৎসে ভ্যাট কর্তন করে ট্রেজারী জমা প্রদান করেছেন। সেটা মোট উৎসে কর্তন থেকে বাদ দিয়ে বাকী ১.১৭ লক্ষ টাকা অপরিশোধিত উৎসে কর্তন বলে দাবী নামা জারি করা হবে এবং সেটা আইন অনুযায়ী তিনি করতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আসলে কি উনি আইন অনুসারে সেটা করতে পারেন ? তাহলে মানব সম্পদ সরবরাহকারী মোট বিলের ১০% হারে এক লক্ষ টাকা কমিশন পেয়ে কিভাবে ১.৩০ লক্ষ টাকা ভ্যাট প্রদান করবেন? আসলে উনার ভ্যাট দায় কিন্ত সমস্ত টাকার উপর না। উৎসে কর্তনকারী প্রতিষ্ঠানের যদি বারতি ১.১৭ লক্ষ টাকা প্রদান করতে হয় সেটা প্রর্দশিত খরচ ১৩.৫০% হারে বেড়ে যাবে। আর ব্যবসায়ীগণ তো লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবেন না উনি সেটা পন্য মূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তার নিকট থেকে আদায় করবেন। এধরনের যত প্রকার সেবা ভ্যাট আইনের তালিকায় আছে সে গুলো কোনটা শতকরা কত হারে পন্য মূল্য বৃদ্ধি করবে সেটা বিস্তারিত ধারাবাহিক ভাবে লিখতে চেষ্টা করব।
প্রতিটা দেশের ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সে দেশের পন্য মূল্যের চেইন এর উপর বিশাল প্রভাব বিস্তার করে। ভ্যাট ব্যবস্থাপনার চেইন সামান্য গড়মিলের কারণে পণ্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেতে পারে। আমরা ভ্যাট আইনের পন্য মূল্যের চেইন প্রভাব নিয়ে চিন্তা করি না। সহজ সমাধানে অভ্যস্ত, সরকার আইনে ভ্যাট বৃদ্ধি করলে ব্যবসায়ীগন ঠিক সে হারে পন্য মূল্য বৃদ্ধি করে দেন। ভোক্তাগন অসহায়ের মত বর্ধিত অংশের টাকা ভিন্ন ভাবে আয় করতে চেষ্টা করেন বা খরচ কম বেশী করে ব্যালেন্স করেন। ভ্যাট ব্যবস্থাপনা সঠিক না হলে প্রতিটা স্তরে সেটা পণ্য মূল্যের সাথে যোগ হয়ে পন্য মূল্য বৃদ্ধি করে। প্রতিটা স্তরের ভ্যাট ব্যবস্থাপনার জন্য আইন বিস্তারিত ভাবে করা সম্ভব না। সঠিক ও আদর্শ ভ্যাট হার অর্থাৎ এক হারে প্রতিটা স্তরে রেয়াত গ্রহনের মাধ্যমে শতকরা ৩-৪% হারে কম মূল্যে পন্য বিক্রয় করা সম্ভব হবে। যেভাবে ঘটনা ঘটবে ঠিক সে ভাবে কোন দিন আইন তৈরী হবে না। তাই জানতে হবে আইনের ব্যবহারিক প্রয়োগ। প্রকৃতপক্ষে ভ্যাট আইনে সকল কিছু বলা আছে। আমরা ভ্যাট আইনের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছি। এদেশে সঠিক ভ্যাট ব্যবস্থাপনা আনতে সেই গানটা গাইতে হবে”যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, তবে হবে হবেই দেখা বিজয়ে”।
লেখকঃ- মোঃ আলীমুজ্জামান, লিড কন্সালটেন্ট, দ্যা রিয়েল কন্সালটেসন