মোঃ আলীমুজ্জামান : মানুষ আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব, সে কারণে এক সেকেন্ড পর তার জীবনে কি ঘটবে সেটা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের পলিসি বা কোন কোম্পানী ও তার পলিসি এ সব কিছু মানুষের তৈরী তাই একটা দেশ বা কোম্পানী কতদূর যাবে সেটার পলিসি মেকারদের বর্তমান পরিকল্পনা থেকে বলে দেওয়া যায়। যে কোন পলিসি বাস্তবায়নে অনেক গুলি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বা কো-সিকুয়েন্স থাকে এবং পলিসি বাস্তবায়ন নির্ভর করে সেগুলোর সমন্বয়ের উপর। যিনি যত দ্রুত এই কো-সিকুয়েন্স গুলি মিলাতে পারবেন তিনি তত দ্রুত বলে দিতে পারবেন সরকার বা কোম্পানীর বর্তমানে গৃহিত পলিসি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না।সরকার বা কোম্পানীর সফলতা নির্ভর করে বর্তমানে পলিসি মেকারগণ কতদূর দেখার ক্ষমতা রাখেন। আমি অনেক দিন ধরে ভ্যাট আইন নিয়ে লেখার ফলে আমার ট্যাক্স অনুরাগীরা খুব রাগ করে আছেন আমি ট্যাক্স নিয়ে কিছু করছি না। সে রকম একজনের কথায় উৎসাহিত হয়ে করোনা (২০২০) – ২০২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ইনকাম ট্যাক্স কিছু কথা লিখতে চাই।
স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে যার বর্তমান আকার ৫.৬৮ লক্ষ কোটি টাকা।
আমাদের আয়কর ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র ব্যক্তি কর দাতার মধ্যে তিন শ্রেনীর করদাতা আছেন। এক- হায়ার কাষ্ট/ব্রাম্মন/সরকারী কর্মকর্তা। যাদের শুধু মূল বেতন ও বোনাস করযোগ্য আয় হিসাবে ধরা হবে। দুই- মিডিল কাষ্ট/নন ব্রাম্মন/বেসরকারী চাকুরীজীবি। যাদের বাড়ী ভাড়া মূল বেতনের অর্ধেক/সর্বোচ্চ তিন লাক্ষ টাকা পর্যন্ত, যাতায়াত ভাতা ৩০ হাজার টাকা এবং মেডিকেল ভাতা বার্ষিক এর ১০% সর্বমোট ৪.৫০ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে তারপর করযোগ্য মোট আয় হবে। তিন- লোয়ার কাষ্ট/ডম, মুচি মেথর/ একক মালিকানার ব্যবসায়ীগন। যাদের ব্যবসায়ীক খরচ বাদ দেওয়ার পর যে লাভ হবে সেটা মোট করযোগ্য আয় বলে বিবেচিত হবে। তার বাসা ভাড়া, যাতায়াত বা কোন দিন অসুস্থ হতে পারবেন না। আর একটা ব্যাতিক্রম সম্প্রদায় আছে, তারা হলেন ব্রাম্মনদের ব্রাম্মন ধনী শ্রেনী বা শিল্পপতিগণ। যাদের কল্যানের জন্য এই বাজেট করা হয়েছে।
বাংলাদেশের উচ্চাভিলাসী, সবচেয়ে বেশী বাজেট প্রনয়ণকারীও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ যোগানদাতা অর্থমন্ত্রী এবং তিনি একজন আমলা ও অর্থনীতিবিদ ছিলেন। উনার বয়স বেশী হলেও কথা বলার সহজ ধরণ উনাকে অন্য সকল অর্থমন্ত্রী থেকে আলাদা করে রাখবেন সারা জীবন। বাজেট ঘোষনার পর খুব সহজ স্বিকার উক্তি ”আমি উচ্চাভিলাশী মানুষ তাই বাজেট আপনাদের কাছে সে রকম মনে হলে ও আমার কাছে সেটা বাস্তবায়ন যোগ্য এবং তিনি সেটা প্রমান করে দেখিয়ে ছিলেন যে স্থানীয় রাজস্ব কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়। ২০০৮-০৯ সাল থেকে ৯ বিগত ২০১৫-১৬ সালে এনবিআর এর মোট রাজস্ব আদায় ছিল ১.৫৩ লক্ষ কোটি টাকা উনার শেষ সময়ে ২০১৮-১৯ সালে ২.২৩ লক্ষ কোটি টাকায়। যা বাংলাদেশ এর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। উনি আসলে আশি বছরের যুবক ছিলেন বলেই হয়ত উচ্চাভিলাসী বাজেট বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন নতুন ভ্যাট আইন বিভিন্ন হারে প্রয়োগ করা হলে সেটা রাজস্ব বান্ধব হবে না এবং তিনি সেটা ২০১২ সাল থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত এক হার আনতে পারেন নাই বলে পুরাতন ভ্যাট আইনে সে পর্যন্ত চালিয়ে জান। আসলে তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাসী অর্থনীতিবিদ। হিসাবের এত জটিল কারিশমা তিনি বুঝতেন না। হিসাবের উপস্থাপন বা কারিশমার মন্ত্র ”লাগ ভেলকি লাগ, আমার ওস্তাদের চোখ বাদ দিয়ে সবার চোখে লাগ” সেটা উনার জানা ছিল না বলে কারো কথা মনমত না হলে বলতেন টোটাল রাবিশ।তাই তিনি কর আয়ের লিমিট না বারিয়ে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের সাথে হিসাবীয় কারিশমা দেখিয়ে উচ্চ ধনী শ্রেনীকে কর দায়ের সুবিধা প্রদান করেন নাই।
হিসাববিদ এর হিসাবীয় কারিশমা নিয়ে কথা বলার আগে একটা কথা বলে রাখি, আমি নিজেও সি এ (সিসি) করা। আমার রেজিট্রেশন নম্বর ৪৬৬৯/৯৩। প্রায় ১৩ বছর হিসাব বিভাগে চাকরী করেছি। কথা গুলি বলতে কষ্ট হলেও উচিত কথা বলা দরকার। এবার কারিশমায় আসা যাক, বিগত ৬ বছরের অপরিবর্তিত সবার কাংক্ষিত কর যোগ্য আয় ৩ লাখ টাকা করা হয় সাথে বোনাস হিসাবে করযোগ্য আয়ের প্রথম স্লাব ১০% থেকে ৫% হয়। সারা দেশে মধ্যম আয়ের আমাদের মত মানুষগুলি উনার গুনকেত্তন গাওয়া শুরু করলাম। এর মধ্যে তিনি উনার ও সন্তানদের সমপর্যায়ের মানুষগুলির বিশাল সুবিধা প্রদান করলেন সর্বোচ্চ কর হার ৩০% থেকে কমিয়ে ২৫% নামিয়ে আনলেন। বলবেন এটাও তো কমানো হল। সমস্যাটা বাধল যখন হিসাব করতে বসলাম। করযোগ্য সীমা বাড়িয়ে কমানো ৫% হারে স্লাব এ রাখলেন মাত্র এক লাখ টাকা। বেসরকারী কোম্পানীতে চাকুরিরত/ মিডল কাষ্ট আয়কর দাতার বাৎসরিক আয় ২২ লাখ টাকা। উনার প্রাপ্ত সুবিধা ৪.৫০ লক্ষ টাকা বাদ দিয়ে প্রস্তাবিত আয়কর আইনে মোট করদায় হবে ২,৮৯,৮০০/= টাকা যাহা পূর্বের আইনে সমস্ত কিছু এক বিবেচনায় রাখলে করদায় হত ২,৩৫,০০০/= টাকা। করযোগ্য সীমা কমানো ও করহারের স্লাব ৫% করেও উনার কর বেশী দিতে হবে ৫৪,৮০০ টাকা কারণ পূর্বের আইনে সীমা ও হার বেশী হলেও এই আয়ে তাকে সর্বোচ্চ ২০% হারে কর প্রদান করতে হত। বর্তমানে স্লাব গুলির কারণে প্রায় ৩.৮০ লক্ষ টাকা সর্বোচ্চ হার ২৫% এ যাওয়ার কারণে করদায়ের পরিমান বেশী হবে।তবে হায়ার কাষ্ট/ব্রাম্মন/সরকারী কর্মকর্তাগনের বাৎসরিক ২২ লক্ষ টাকা আয় ধরলে নতুন আইনে করদায় হবে ১,৯৬,০০০/= টাকা যা পূর্বের আইনে হত ২,০৬,০০০/= টাকা অর্থাৎ উনাদের করদায় কমবে ১০ হাজার টাকার মত। আর লোয়ার কাষ্ট/মেথর মুচি/ মধ্যম শ্রেনীর ব্যবসায়ীর ব্যবসায়িক খরচ বাদ দেওয়ার পর সেই বাৎসরিক ২২ লক্ষ টাকা আয় ধরলে নতুন আইনে মোট করদায় হবে ৩,৪৫,০০০/= টাকা এবং পুরাতন আইনে মোট করদায় হত ৩,৪৭,৫০০/= টাকা যাহা মাত্র ২,৫০০/= টাকা কম হবে। বর্তমানে এই মেথর মুচির ৩ কোটি টাকার উপরে বিক্রয় হলে লাভ বা লস যা হোক না কেন টার্ণওভারের উপর ০.৫% হারে নূণ্যতম ট্যাক্স দিতে হবে। এ তো গেল ব্রাম্মন, ননব্রাম্মন ও মেথর মুচির বাৎসরিক সমান আয় হলেও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় হিসাবীয় কারিশমার বর্তমান ও পূর্বের আইনের করদায় এর পার্থক্য বা লাগ ভেলকি লাগ, আমার ওস্তাদের চোখ বাদ দিয়ে——-।
পূর্বের আয়কর আইনে বাৎসরিক ৫২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় থাকলে ২৫% থেকে ৩০% স্লাব এ পরত। পুরাতন ও নতুন আইনে সে আয়ের মোট করদায়ের পার্থক্য ২,৫০০/= টাকা। তাহলে এ আইনের সুবিধা কারা পেলেন? পেয়েছেন যারা সকল সুবিধা ভোগ করেন তারা, হ্যা সেই ধনী শ্রেনীর মানুষেরা। ধরা যাক এক জনের বাৎসরিক আয় ২ কোটি টাকা এবং উনার নেট সম্পদ এর পরিমান ২০ কোটি টাকার উপরে। তার বর্তমান আইন ও পুরাতন আইনের মোট করদায় কমবে ৭,৪২,৫০০/= টাকা এবং এর উপর ৩০% সারচার্জ হিসারে আরো কম দিতে হবে ২,২২,৭৫০/= টাকা সর্বোমোট করদায় কম হবে ৯,৬৫,২৫০ টাকা। এভাবে যত আয় বাড়বে করদায় তত কমতে থাকবে। আসলে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে ভিষন- ২০২১ বাস্তবায়নের আগে রুপপ্রকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছি। পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কোটিপতি বৃদ্ধির হার সবথেকে বেশী যা ১৭% এর উপরে। তাই তাদের সুরক্ষিত রাখতে বর্তমান আইনকরা হবে সেটা স্বাভাবিক ভাবে বলা যায়। এর আরো বড় প্রমান তিনি রেখেছেন ব্যক্তিগত গাড়ীর ট্যাক্স বৃদ্ধির হারে ১৫০০ সিসি থেকে ২০০০ সিসি পর্যন্ত অগ্রীম আয়কর বৃদ্ধির হার ৬৬.৬৬%, ২৫০০ সিসির বৃদ্ধি ৫০%, ৩০০০ সিসির বৃদ্ধি ৩৩.৩৩% ও ৩৫০০ সিসির বৃদ্ধির হার ২৫%। এই সিসি দেখে কানার বাবা অন্ধ ও বলে দিতে পারবেন কোন সিসির গাড়ী কোন শ্রেনীর লোকেরা ব্যবহার করেন
তবে বেশকত দিন ধরে একটা খবর দেখা যাচ্ছে সেটা হল ঢাকা শহরে বাড়ী ভাড়া নেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে বলা হয়েছে ঢাকা শহরের ক্ষুদ্র থেকে মধ্যম শ্রেণীর ব্যবসায়ীগণ বিগত ৩ মাস করোনায় বন্ধ থাকায় তারা পরিবার সহ বা পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে নিজেরা কোন মত ম্যাচ ভাড়া করে থাকছেন। বেসরকারী চাকরীজীবি বেশীর ভাগ মালিকগন ৩০% থেকে ৪০% বেতন কমিয়ে বিগত ৩ মাস বেতন দিলেও কোরনা কবে শেষ হবে সেটার কোন নিশ্চয়তা না থাকার কারনে তারা ও সেই একই পথে হাটছেন বা বেশী মূল্যের ভাড়া বাসা থেকে কম ভাড়ার বাসা নিচ্ছেন। তাই যাদের টার্গেট করে বাজেট করা হয়েছে তাদের ট্যাক্স আদায় করতে তাদের সাথে বিভিন্ন কর কমিশনারেট গুলিও গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। সেটা করতে না পারলে যে টার্গেট ট্যাক্স আদায়ে দেওয়া হয়েছে সেটা আদায় করা সম্ভব হবে না। ভ্যাট আদায়ের কারিশমার মত যদি ব্যার্থ হয় তাহলে তো আমার ওস্তাদের চোখেই কারিশমার ভেলকি লেগে যেতে পারে।
লেখকঃ- মোঃ আলীমুজ্জামান, লিড কন্সালটেন্ট, দ্যা রিয়েল কন্সালটেশন ফাউন্ডার- টিআরসি- রাজস্ব ভাবনা,