মোঃ আলীমুজ্জামান : একবার এক পলিসি মেকার থিওরী দিলেন পানি দিয়ে এ্যারোপ্লেন চালানো যাবে। এই থিওরী দেওয়ার সাথে সাথে উনি তো বিখ্যাত লোক হয়ে গেলেন। চারিদিকে হইচই পরে গেল এটা তো বিশাল সেভিংস খরচ ছাড়া প্লেনে চালানো যাবে। পৃথিবীর সমস্ত সংবাদিক সেই পলিসি মেকার এর সংবাদ প্রচার করতে থাকলেন। উনাকে সংবাদিক সম্মেলনে ডাকা হল এবং সেটা সারা পৃথিবী জুড়ে এক যোগে প্রচার শুরু হল। এক সাংবাদিক খুব ভয়ে জানতে চাইলেন ”স্যার বিষয়টা কিভাবে করা হবে বা বর্তমান প্লেনে ব্যবহৃত ইঞ্জিনে সেটা ব্যবহার করা যাবে কিনা? পলিসি মেকারের সোজা উত্তর ”থিওরি দেওয়া আমার কাজ সেটা বাস্তবায়ন করা ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব” বর্তমানে আমাদের দেশের ভ্যাট আইনের অবস্থা ঠিক এরকম। নতুন ভ্যাট আইনে অডিট ব্যবস্থাকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্ত সেটা করতে ফিল্ড অফিসারদের দেওয়া হয় নাই কোন গাইড লাইন। যে যার ইচ্ছা অনুযায়ী আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ৪ লাখ টাকা ভ্যাট প্রদানকারী একটা প্রতিষ্ঠানে ৪ কোটি টাকার ভ্যাট দাবীনামা জারি করছেন। বিষয়টা অনেকটা এরকম লাশ ফালানো আমার কাজ, কবর দিবে আন্জুমান মফিদুল ইসলাম। সবই বেওয়ারিশ আর কি?
নতুন ভ্যাট আইনে ১৫% হারে ভ্যাট প্রদান করা উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের পুরাতন আইনের তুলনায় অনেক সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ভ্যাট হল একটা সেল্ফ এ্যাসেসমেন্ট ট্যাক্স যার সকল দলিলাদি ব্যবসায়ীর কাছে থাকবে এবং তিনি সঠিক ভাবে ভ্যাট আদায় করে সরকারী কোষাগারে জমা প্রদান করবেন কিন্ত আমাদের দেশে উল্টা চিত্র দেখা যায় বা ব্যবসায়ীগণ জানেন না ভ্যাট আদায় করে প্রদান করবেন না নিজের টাকা থেকে দিবেন। তবে একটা বিষয় পরিস্কার যে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীগণ ভ্যাট প্রদান করাকে লাভের অংশ থেকে প্রদান করছেন বলে মনে করেন। ব্যবসায়ীগণের এ ধরনের মানসিকতার জন্য দায়ী সরকারের পলিসি মেকারদের পানি দিয়ে প্লেন চালানোর থিওরী প্রদান। নতুন ভ্যাট আইন অনুসারে ব্যবসায়ীগন বা উৎপাদনকারী মূসক ফরম-৬.৫ এর মাধ্যমে ভ্যাট প্রদান করা ছাড়া বিভিন্ন ডিপো বা শো রুমে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের মাধ্যমে পণ্য স্থানান্তর করতে পারবেন। যেখানে আগের আইনে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের জন্য বলা ছিল যে প্রতিটা ডিপো বা শোরুমে পন্য স্থানান্তর করতে হলে প্রতি টা ডিপোর জন্য কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের স্থান থেকে ভ্যাট প্রদান করার জন্য প্রতিটা ডিপোর আলাদা মূল্য সংযোজন করে মূল্য ঘোষনা প্রদান করে সেই সম্পূর্ণ টাকার উপর ভ্যাট প্রদান করে তার পর ডিপো বা শেরুমে নেওয়া হত এবং সেখান থেকে শূণ্য মূসক চালানে পন্য বিক্রয় করা হত।
১৯৯১ সালে প্রথম আমাদের দেশে ভ্যাট আইন পাশ করার সময় সুইডেন ও ডেনমার্ক এর ভ্যাট আইনের আদলে করা হয় কারন সেই দুই দেশের ভ্যাট আইনকে সারা পৃথিবীর আদর্শ ভ্যাট আইন হিসাবে দেখা হত। যুগের পর যুগ চলার পর ও সে দেশের মানুষ আইনের কোন দূর্বলতা খুজে পান নাই। সেই মডেল কিছুটা আমাদের দেশের উপযোগী করে পাশ করার পরও প্রথম মাসে কয়েক শত এসআরও জারি করা হয় কারন আমরা এই কয়েকশত দূর্বল জায়গা বের করে ভ্যাট কম দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলি। সেই আমাদের দেশে নতুন মূসক আইনে কোন ভ্যাট প্রদান করা ছাড়া বা কি ভাবে সেটা মূল্য নির্ধারণ করা হবে সেটার কোন গাইড লাইন তৈরী না করে মূসক -৬.৫ এর মাধ্যমে কোন ভ্যাট প্রদান করা ছাড়া পন্য স্থানান্তরের আইন পাস করা হয়। বলা আছে বিনিময় মূল্য বা ফেয়ার বাজার মূল্যের উপর ভ্যাট আদায় করা হবে। ভ্যাট আইনে পণ্য মূল্য নির্ধারণে যত গুলি পদ্ধতির কথা বলা আছে তার কোন টাই বাস্তব ভিত্তিক না কারণ এটাকে বাস্তব ভিত্তিক করতে হলে বা ব্যবসায়ীগন বা উৎপাদকের নিকট থেকে সঠিক ভ্যাট আদায় করতে নতুন ব্যবসায়ী বান্ধব আইনে যে পরিমান অডিট করা দরকার বা অডিট এর কাজ সঠিক ভাবে করতে সরকারের যে পরিমান দক্ষ জনশক্তি দরকার সেটার কিছুই নাই। এমন কি কোন পদ্ধতিতে অডিট করলে এই ব্যবসায়ী বান্ধব আইন খেকে সরকার ন্যায্য ভ্যাট পাবেন সেটার কোন ম্যানুয়াল সঠিক ভাবে করা হয় নাই। চলতি অর্থ বছরে সরকারের ভ্যাট আদায়ের ধস নামার মূল কারন হলো কোন নিময় নীতি ছাড়া মূসক- ৬.৫ দ্বারা পন্য স্থানান্তরের সূযোগ করে দেওয়া।
আমাদের গ্রামে একটা প্রচলিত কথা হল এমনিতেই বউ রাধে না পান্তা আর গরম। এদেশের ব্যবসায়ীদের সঠিক গাইড লাইনে রেখে ভ্যাট আদায় করা কঠিন হচ্ছিল, বিপরীতে এখন ভ্যাট প্রদান করার সমস্ত স্বাধীনতা তাদের হাতে। বিনিময় মূল্য বা ফেয়ার বাজার মূল্য অনুসারে যদি সঠিক ভ্যাট আদায় করতে হয় তাহলে একজন ব্যবসায়ীর প্রতিটি বিক্রয় সংক্রান্ত লেনদেন এনবিআর এর মনিটরিং এ থাকতে হবে অর্থাৎ উৎপাদক ও ব্যবসায়ীর প্রতিটি ব্যাংক হিসাবে গ্রহনকৃত টাকার প্রতিটার ব্যাখ্যা এনবিআর এর জানা থাকতে হবে। যা একমাত্র এদেশের ভ্যাট ব্যবস্থাকে অটোমেশন করা ছাড়া সম্ভব হবে না। যেখানে সারা দেশের ১০% থেকে ১৫% ব্যবসায়ীর মাসিক সামারী লেনদেন অর্থাৎ মূসক ৯.১ ভ্যাট রির্টান অনলাইনে প্রদান করতে পারেন না, সেখানে কিভাবে সম্ভব হবে একজন ব্যবসায়ীর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন মনিটরিং করা? অন্য আর একটা বিষয় যদি হয় এই করনার ভয়ে আমরা সবাই মৃত্যুর কথা চিন্তা করে ভ্যাট ফাকির হিসাব ওপারে গিয়ে দেওয়ার ভয়ে সবাই ভ্যাট আইন প্রতিপালন করে ব্যাংক হিসাবে জমা টাকা ভ্যাট সহ ধরে নিয়ে নিজের অংশ রেখে সরকারী অংশ কোষাগারে জমা প্রদান করি। সেটা ও হবে বলে মনে হয় না কারণ বর্তমানে করোনা হলে যে কেউ যে কোন সময় মারা যাওয়ার সম্ভবনা আছে। এই রোগের এমন কোন গ্যারান্টি সহ ওষুধ নাই। তারপর ও সামান্য মানবিকতা আমরা দেখী নাই, একদিকে হাজার হাজার মানুষ সরকারী সাহায্য পেতে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে রাস্তায় মিছিল করছেন অন্যদিকে মেম্বার চেয়ারম্যান এর ঘড় থেকে হাজার হাজার বস্তা চাউল আটক করা হচ্ছে। যেখানে ফরজের গুরুত্ব নাই সেখানে নফলের বিষয় সহজে অনুমেয়।
নতুন ভ্যাট আইন-২০১২ কেন ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের সমান ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হল না। সেটার কারণ যদি শুধু করোনা বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ভ্যাট আদায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। আমাদের পানি দিয়ে প্লেন চালানোর থিওরী দেওয়া পলিসি মেকারগণ যদি মনে করে থাকেন শুধু থিওরী দেওয়া উনাদের কাজ বাস্তবায়ন বা টার্গেট ফিলাপ করবেন বিভিন্ন কমিশনারেট এর কমিশনার মহোদয় গণ, তাহলে সেটা নিয়ে কোন কথা নাই। যদি ভ্যাট আদায় বৃদ্ধি করতে হয় তাহলে উনাদেরকে আরো গভীরে যেতে হবে। প্রতিটা সেক্টর ধরে ধরে বিগত বছরের আদায়ের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষন করতে হবে। প্রতিটা সেক্টরে করোনা কালীন সময়ের বিক্রয়কে বিবেচনায় বিগত বছরের বিক্রয়ের সাথে চলতি অর্থ বছরের গ্রোথ বিবেচনায় নিলে সহজে প্রমান করা যাবে করোনার কারণে কি পরিমান ভ্যাট আদায় কম হওয়ার কথা ছিল। সেটা যদি চলতি অর্থ বছরের আদায় এর সাথে মিলে তাহলে ভাল আর যদি সেটার সাথে না মিলে তাহলে সেটার কারণ খুজে বের করে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করা না গেলে আগামী অর্থ বছরে করোনা দূর হলেও ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। আর সে কারণে বিভিন্ন উপসর্গ থাকার কারণে অধিক বয়স্ক লোকের মত অধিক বিয়োগের সরকারী মেগা প্রকল্পে অক্সিজেন (ফান্ড) স্বল্পতায় মৃত্যু বরণ করবেন বা অধিক সুদের লোন দ্বারা সেগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রকল্প ব্যায় অধিক হওয়ার কারণে পরিকল্পনা মাফিক ভিষণ ২০২১ ও রুপপ্রকল্প ২০৪১ শুধুমাত্র স্বপ্নই থেকে যাবে।
জাতির জনকের কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর হাত ধরে সেটা যদি না আসে তবে আমাদের আরো ২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে ভিষন ২০২১ বাস্তবায়নের জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হয়েছে সপরিবারে জাতির জনক হত্যার বিচার পেতে। আর রুপপ্রকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন হতে আরো ৪৫ বছর লাগবে যেমন অপেক্ষা করতে হয়েছে এদেশে রাজাকারদের বিচার পেতে। তবে আমি আশাবাদী জাতির জনকের স্বপ্ন যেমন বিফলে যায় নাই তেমনি ভাবে বিফলে যাবে না উনার সুযোগ্য কন্যার স্বপ্ন। জাতির জনক যেমন বলেছিলেন আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, এদেশের মানুষের মুক্তি চাই। তিনি এ দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। কারন মহান নেতাগন হাজার বছর বেচে থাকেন উনাদের জনগনকে দেওয়া কথা রাখার কারণে। উনারা স্বপ্ন বিলাসি না স্বপ্ন বাস্তবায়ন কারী।
লেখক: মোঃ আলীমুজ্জামান, লিড কন্সালটেন্ট, দ্যা রিয়েল কন্সালটেশন