তিমির বনিক, ষ্টাফ রিপোর্টার: চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল। এখানে চায়ের পরই লেবুর সুনাম দেশ জুড়ে রয়েছে। আর এই শ্রীমঙ্গলের লেবুর চাহিদা ও রয়েছে দেশজুড়ে। বর্তমানে সেই লেবুর চাহিদা হঠাৎ কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন চাষিসহ সংশ্লিষ্টরা।
লেবু বিক্রি ও বিপণন সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নো ম্যানসল্যান্ডে (দুই দেশের মাঝে সমান দূরন্তে থাকা বিদ্যমান ভূখণ্ড) উৎপন্নকৃত ভারতীয় লেবু শ্রীমঙ্গল লেবু বাজারে প্রবেশ করে স্থানীয় চাষিদের উৎপাদিত লেবুর বিক্রিকে অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করছে।
একাধিক চাষি এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, চাষিরা লেবু বিক্রি করতে এসে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে লেবু চাষে উৎসাহ হারাচ্ছেন। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লেবু চাষ এবং ভারতীয় লেবু বাজারে আসায় শ্রীমঙ্গলের লেবু বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় লেবু বাজার সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের লেবুর বাজার থেকে প্রতিদিন প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ লেবু রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকাররা নিয়ে যেত। হঠাৎ করে সেই চাঙ্গা বাজার পড়ে গেছে। বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ৫০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে। প্রতি পিস লেবুর দাম আগে ছিল দুই টাকা থেকে পাঁচ টাকা। কিন্তু চলতি মৌসুমে এই সময়ে লেবুর দাম নেমে এসেছে প্রতি পিস ৫০ পয়সা থেকে দেড় টাকায়। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন লেবু চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রের বরাত দিয়ে জানায়, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জসহ সাত উপজেলার পাহাড়-টিলার মাটি ও আবহাওয়ার কারণে লেবু চাষের জন্য খুবই উপযোগী। প্রতি মৌসুমে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপকহারে কাগজি, চায়না, জারা, পাতি ও কাটা লেবুর উৎপাদন হয়। তবে সবচেয়ে বেশি লেবু উৎপন্ন হয় শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি ও সমতল এলাকায়।
লেবু ব্যবসায়ী জাহেদুর রহমান বলেন, শ্রীমঙ্গলের বাজারে লেবুর দাম আশানুরূপ না বাড়ার কারণ হলো ঢাকার ব্যবসায়ীরা শ্রীমঙ্গলের লেবু নিচ্ছেন না। তারা যদি আগের মতো নিতেন তাহলে তো এ সমস্যা হতো না। রোজার পরে আমরা লস খেয়ে গেছি। রোজার সময় বা এর এক মাস আগেও ভালো দাম ছিল। এখনকার বাজারে ভালো লেবু তেমন নেই। যা আছে তা খুবই অল্পবিস্তর। বড় রসালো লেবুর চাহিদা সব সময়ই বেশি। বর্তমানে আমি আমার লেবু বাগানের এক ঠেলাগাড়ি অর্থাৎ ৮শ লেবু বিক্রি করেছি ৭শ টাকায়। ফলে বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক ভাবে মারাত্মক ক্ষতি গুণতে হচ্ছে। রমজানে এই একঠেলা লেবু বিক্রি করেছি প্রায় ৮ হাজার টাকায়। আমাদের শ্রীমঙ্গলের বাজারে বেশিরভাগ লেবুগুলো কাগজি লেবু।
শ্রীমঙ্গল কাঁচা বাজারের আড়তদার আবু তাহের প্রথমেই বলেন, ভাই, লেবুর বাজার ভালো না। কারন আগে এখনকার লেবুগুলো যেখানে যেতো তা আর যাচ্ছে না। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ভারতীয় লেবু আমাদের বাজারে এসেছে, ফলে আমাদের শ্রীমঙ্গলের লেবুর বাজারের চাহিদা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইন্ডিয়ান ওই লেবুগুলো সীমান্তবর্তী নোম্যানসল্যান্ডে চাষ করা। সেখানে নতুন মাটি ফেলে লেবু চাষ করায় এর সাইজগুলোও বড় বড় হয়। ফলে আমাদের স্থানীয় লেবুগুলোর আর কোনো চাহিদা থাকে না। এখন স্থানীয় লেবু পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে লেবু ব্যবসায় ধস নেমে এসেছে। আমার কাছে প্রায় শতাধিক লেবু মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আমাদের সবারই আজ জান বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে।
শ্রীমঙ্গল এলাকার লেবু চাষি ফারুক মিয়া বলেন, গাছ থেকে এক গাড়ি (২ হাজার পিস) লেবু সংগ্রহে মজুরি দিতে হয় ৭৫০ টাকা, বাজারে নিয়ে যেতে গাড়িভাড়া এক হাজার টাকা। আমার একগাড়ি লেবু বাজারে তুলতে মোট খরচ হয় এক হাজার ৭৫০ টাকা। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। একদিন ৪শ টাকা লাভ হলে পরের দিনেই ৩শ টাকা লস হয়। এতে লেবু চাষে আর উৎসাহ পাচ্ছি না।
সিলেট থেকে লেবু কিনতে আসা ব্যবসায়ী রহিম মোল্লা বলেন, গত বছরের পর এবার হঠাৎ লেবুর বাজারে এই পরিবর্তন এসেছে। মূলত দেশের বিভিন্ন জায়গায় লেবুর চাষ বেড়েছে। আগে যেভাবে সারা দেশের লেবুর চাহিদা পূরণ করত শ্রীমঙ্গল। এখন আর সেভাবে নেই। দেশের চাহিদা পূরণ হয়ে যায় অন্যান্য এলাকার লেবু থেকেই। তাই স্থানীয় বাজারে দাম পড়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ডিডি) সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, আড়তদাররা বেশি লাভের জন্য এখন আর লেবু কিনছে না। ঢাকায় তো ঠিকই লেবুর দাম বেশি। আড়তদারদের হাতেই অনেক কিছু নির্ভরশীল। বাজারদর ওঠানামা করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে চাষিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে তারা খেয়াল রেখে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন। আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বলে দিচ্ছি এ বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এই জেলার মাটি ও আবহাওয়া লেবু চাষের জন্য খুবই উন্নত। মৌলভীবাজার জেলায় ১৭১৯ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হচ্ছে।