October 7, 2024 - 2:18 pm
তথ‌্য অ‌ধিদপ্ত‌রের নিবন্ধন নম্বরঃ ৭৭
Homeসম্পাদকীয়কামরুস সালামের ফিরে আসা এবং তার উপলব্ধি

কামরুস সালামের ফিরে আসা এবং তার উপলব্ধি

spot_img

সম্প্রতি কামরুস সালাম (সোহান) নামের এক তরুণের আইএসে যোগদানের জন্য সিরিয়ায় যাওয়া ও ফিরে আসার কাহিনী নিয়ে গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায় কিভাবে সে আইএসে অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং কিভাবে যোগদান করে পরে ফিরেও এসেছে। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যেসব তরুণরা আইএসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হচ্ছে তাদের অনেকেই আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর বাস্তব নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে কিছুই জানে না। এর আগেও এ রকম বেশ কিছু তরুণকে আইএসে যোগদান করে ভুল বুঝতে পেরে নিজ নিজ দেশে ফিরে আসতে দেখা গেছে। তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে হয়তো বা এই কামরুস সালামের নামটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর কারণ তার এই আইএসে যোগদানের পেছনে রয়েছে বৃত্তান্ত ইতিহাস।
কামরুস সালাম ডেসকোর কর্মকর্তা ছিলেন। তার পারিবারিক বৃত্তান্ততেই দেখা যায়, সে বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারেরই সন্তান। তার বাবা ছিলেন ঢাকাসহ চার বোর্ডের চেয়ারম্যান। বাবা-মা দুজনেই মারা যান। মা যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হোন তখন তার কাছে আপন বলতে তেমন কেউ ছিল না। ঠিক এ সময়তেই তিনি ইন্টারনেটে বেশ সময় কাটান এবং সেখান থেকেই এক্স ক্যাডেট ইসলামিক লার্নিং নামের একটি গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হোন। সেখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। এরপর তিনি বিভিন্ন জনের সহায়তায় সিরিয়াতে যান এবং সেখানে আইএসের অধীনে কয়েকটি দিন কাটানোর পরে বুঝতে পারেন তিনি এক জটিল চক্রে পা দিয়েছেন। পরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বহু কষ্টে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হোন। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। ভুল বুঝতে পারলেও আইন তো আর সেসব দেখতে যাবে না। তিনি একটি অপরাধ চক্রের সাথে জড়িত ছিলেন এ কারণেই তাকে এখন কারাগারে থাকতে হচ্ছে। অবশ্য আমাদের দেশেও এমন আইন নেই যেখানে কেউ অপরাধ চক্রের সাথে জড়িত হয়ে পরে ফিরে এসে সংশোধনের চেষ্টা করলে তাকে সুযোগ দেয়ার। এ ধরনের আইন সাধারণত বিশ্বের কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই দেখা যায়।
কামরুস সালামের এই কাহিনী থেকে জানা যায়, তিনি প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সহিংসতার কারণে সেখানে মুসলিমদের নির্যাতন হতে দেখে আইএসকে তার সমাধান মনে হয়েছিল। এর কারণ আইএস তাদের প্রচার-প্রচারণায় সবসময় বলে থাকে যে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর আমেরিকা ও ইউরোপসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে, আর এর প্রতিশোধ হিসেবে তারা এ রকম সহিংস জিহাদ বেছে নিয়েছে। এ কারণেই বর্তমানে ধর্মের প্রতি দুর্বল থাকা অনেক তরুণ তাদের দিকে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, আইএস নিজেও সেখানকার অনেক মুসলিমদের নিষ্ঠুর কায়দায় হত্যা করেছে। তাদের ভাষায়, যারা তাদের ইসলামী ব্যাখ্যার সাথে একমত নয় তারা সকলেই কাফির। সুতরাং, তাদের হত্যা করা যায়েজ হয়ে যায়। এভাবে তারা অসংখ্য মুসলিমদের হত্যা করেছে, অনেক নারীকে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণসহ যৌন দাসীতেও পরিণত করেছে। আর সেখানকার অমুসলিমদের উপর আরো ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে তারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইয়াজিদি সম্প্রদায়দের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। ইয়াজিদি অনেক নারীদের যৌন দাসীতে পরিণত করেছে। ধ্বংস করেছে তাদের ঘরবাড়ি, লুট করেছে তাদের সম্পদ। এসব বিষয় অনেক তরুণরাই জানে না। আবার যারা যেনে বুঝে যায় তারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে। কামরুস সালাম ওভাবে জানতেন না, পরে সেখানে গিয়ে বুঝতে পেরে তার ভিতর অনুশোচনা হয়। এজন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তিনি ফিরে এসেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে সত্যিকার অর্থে আরো বিষদ আলোচনা হওয়া দরকার । যারা এখনো জানে না তাদের বিষয়গুলো বুঝাতেই এ রকম আলোচনা হওয়াটা জরুরি।
মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতের পেছনে অনেকে শুধু পশ্চিমাদের দায়ী করেই বসে থাকেন। কিন্তু সেখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিগুলোর দিকে দৃষ্টি দেন না। অথচ, মধ্যপ্রাচ্যে আজ এই পরিস্থিতির পেছনে সেখানকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিও কোন অংশে কম দায়ী নয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি আজ কয়েকভাবে বিভক্ত। আর সে বিভক্ত রাজনীতির সাথে ধর্ম ও জাতিগত বিভেদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ নিয়েই মধ্যপ্রাচ্য আজ রক্তে রঞ্জিত। সে রক্তের খেলায় পশ্চিমাসহ বিশ্বের অন্যান্য প্রভাবশালী দেশগুলো তাদের স্বার্থ হাসিল করতে একাট্টায় যোগ হয়েছে। ফলে, রক্তের খেলা আরো ভালভাবে জমে উঠেছে। এ নিয়ে আজও সেখানে চলছে যুদ্ধ আর যুদ্ধ। এসবের মাঝেই কিন্তু আইএস নামক জঙ্গি গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে। তারা এসবের সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের দল ভারী করতে ইন্টারনেটে প্রচার চালিয়ে বেশ ভালভাবেই নিজেদের একটি অবস্থা গড়ে তুলেছে। ইরাক আগ্রাসনের পর পর এই আইএস নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। পরবর্তীতে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০১১ সালের দিকেই প্রকাশ্যে নিজেদের আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। আর ২০১২ সালের পরেই বিশ্ববাসী তাদের তা-ব দেখতে শুরু করে। একে একে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসহ তুরস্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি বাংলাদেশও বাদ যায়নি তাদের ছবল থেকে।
যারা আইএসকে সমর্থন করে তাদের যে কেউই কিছু জানে না তা নয়। তাদের কেউ কেউ এ বিষয়গুলো বেশ ভালভাবেই জানে। কিন্তু তারা বহু আগে থেকেই আইএসের মত এ রকম ভয়ংকর মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল। কিন্ত কোন চ্যানেল খুঁজে পাচ্ছিলেন না বিধায় নিশ্চুপ ছিল অনেক দিন। যেই সন্ধান পেয়েছে সেই ওখানে যোগদান করেছে।
আবার, আইএসে যোগদানকারীর একটি অংশ রয়েছে যারা জীবন নিয়ে এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে আইএসকে তার সমাধান হিসেবে বেছে নেয়। এদের অধিকাংশের জীবন কাহিনীতে দেখা যায়, তাদের ভাল করে দেখভালের কেউ ছিল না। যেমন কামরুস সালামের কথাটাই ধরা যেতে পারে। তার বাবা-মা দুজনই মারা যায়। আত্মীয়-স্বজনের তেমন কোন সমর্থন ওভাবে পায়নি। এদের এভাবে যোগদান করার কারণে কত মানুষের জীবন যে বিপন্ন হয় তারা তা জানে না। কামরুস সালাম বুঝতে পারায় তাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। সে যদি কোন হত্যা না করে থাকে অন্তত তাকে এ কারণে সাধুবাদ জানাতে হয়। আর যেন কেউ কামরুসের মত ভুল না করে, সে বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। কেউ যেন এসব জঙ্গিবাদের দিকে পা না বাড়ায় সেজন্য আমাদের বুঝতে হবে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কি কি অসঙ্গতি রয়েছে।
অভিভাবকদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে তার সন্তান ইন্টারনেটে কি করছে। সবসময় প্রাইভেসির অযুহাত তুলে তাকে অবাধে গোপনে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ দিলে সে যে এ রকম কোন কিছুর দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে না সে গ্যারান্টি আমরা কেউ দিতে পারবো না। তবে সবচেয়ে ভাল হয় সন্তানকে আইএসসহ অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠী সম্পর্কে ভালভাবে বুঝিয়ে বলা। মানুষ হত্যা কিংবা ধর্ষণ করাটা কোন ধর্ম হতে পারে না Ñ এ বিষয়টা তো বুঝানোর দায়িত্ব অভিভাবকদের। সন্তানকে অযথা বকাবকি না করে তার সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা উচিত, যেন সে আপনার কাছে সবকিছু খুলে বলে। ফলে আপনিও কিন্তু অবগত থাকতে পারবেন তার কর্মকান্ড সম্পর্কে। বর্তমান এই ব্যস্ততম যুগে শুধু কাজের পেছনে না দৌঁড়িয়ে একটু পরিবারকে সময় দিন। এ ক্ষেত্রে বাবা-মা সকলকেই সমানভাবে তার দায়িত্ব পালন করাটা জরুরি। উভয়কেই তাদের সন্তানকে সময় দেয়া উচিত। কামরুস সালাম তার বাবা-মার আদর-যতœ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত ছিলেন বিধায় হয়তো বা সে আর পার্থিব জীবনকে ভালবাসতে পারেনি। তার বাবা-মা মারা যাওয়ায় তাকে এ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। কিন্তু যাদের আছে তাদের যেন এ রকম কোন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখাটা আমাদের সবার কর্তব্য।
বর্তমানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান যেভাবে চলছে চলুক। দেশের সরকার না হয় সেদিকটা লক্ষ্য রাখবে কিন্তু অন্যান্য যে বিষয়াদি এর পেছনে রয়েছে সেসব দিকে লক্ষ্য রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। কামরুস সালামের এই কাহিনীটি যেন আমাদের সেই দিকটাকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমাদের সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টাই পারবে দেশের প্রতিটি তরুণকে জঙ্গিবাদের কবল থেকে মুক্ত রাখতে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন
spot_img

সর্বশেষ সংবাদ