নিজস্ব প্রতিবেদক : সীমিত আয়ের জনগণকে স্বস্তি দিতে করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ টাকা বাড়িয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে ইকোনমিক রিপোরটার্স ফোরাম (ইআরএফ)। একই সঙ্গে রাজস্ব ফাঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব রাখেন।
রবিবার ১২ ফেব্রুয়ারি আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত জাতীয় রাজস্ব ভবনে (এনবিআর) প্রাক বাজেট আলোচনায় সংগঠনের নেতারা এসব প্রস্তাব দেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন ইআরএফের সভাপতি মো. রেফায়েত উল্লাহ মীরধা, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম প্রমুখ।
আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, বাজেটের মূল উদ্দেশ্যই থাকে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে মধ্যবিত্তে উন্নীত করা। মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেনীতে নিয়ে যাওয়া। মানুষের অবস্থার উন্নতি ও মাথাপিছু আয় বাড়ানো।
আলোচনায় ইআরএফ নেতারা বলেন, একজন ব্যক্তির মাসিক আয় ৪১ হাজার ৬৬৬ টাকা বা তার বেশি হলে তাকে করের আওতায় আনা হবে। অন্যদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট একজন ব্যক্তির মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকার বেশি হলেই তিনি করের আওতায় ছিলেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। ধারাবাহিকভাবে পরের ২ বছরে দশমিক ৫ শতাংশ ও দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।
দেশে ইটিআইএনধারীর সংখ্যা ৮৬ লাখের মতো জানিয়ে আরও বলেন, এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন ২৮ লাখ। বাকি ইটিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার ওপরে জোর দেন। একই সঙ্গে কর, শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দেন ইআরএফ।
বাজেট আলোচনায় ইআরএফের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক লিখিত আকারে একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন। প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হলো- ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ধাক্কা সামলাতে এখন থেকেই গতিশীল রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। ডাব্লিউটিও বাউন্ড ট্যারিফ কার্যকর করার পদক্ষেপ আগামী অর্থবছর থেকেই পর্যায়ক্রমে আগামী ৩ অর্থবছর ধরে প্রস্তুতি নিতে হবে, যার কার্যক্রম আগামী অর্থবছর থেকে শুরু করা দরকার;
এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী প্রতিযোগিতামূলক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতেও পদক্ষেপ নিতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুক্ত বানিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়টি বিবেবচনায় রেখে শুল্কহার যৌক্তিক করার কাজ আগামী বাজেট থেকেই শুরু করার প্রস্তাব করছি। বাংলাদেশে শুল্কহার এলডিসিগুলোর গড় শুল্কহারের তুলনায় বেশি এবং প্রোটেকটিভ ট্যারিফ গড়ে ২৮ শতাংশ। এই হার কমিয়ে আনার প্রস্তাব করছি, যাতে এফটিএ করার পর রাজস্বের ধাক্কা একবারে না আসে;
এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। ভারত সরকারের সম্প্রতি ঘোষিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে ৭ লাখ রূপী নির্ধারণ করেছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সীমিত আয়ের জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ব্যক্তিখাতে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে;
আইএমএফ এর শর্ত পূরণ করতে আগামী বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে, পরের দুই বছরেও দশমিক ৫ শতাংশ ও দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। এই বাড়তি রাজস্ব আহরণে করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো, অটোমেশনের মাধ্যমে কর কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা;
ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে দীর্ঘদিন ধরে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো চালুর কথা শুনা গেলেও তার দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো চালু করা, নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এনবিআরের বিভিন্ন সেবা বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে যুক্ত করাসহ ব্যবসার পরিবেশ সহজ করতে আগামী বাজেটে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করছি। বিভিন্ন সেবা ফি অনলাইনে এক স্লিপে নেওয়ার ব্যবস্থা করা;
কর অব্যাহতি সুবিধা সাধারণত এক কর বছরের মধ্যে বিনিয়োগের শর্তে দেওয়া হয়। কিন্তু কোন শিল্প স্থাপন ও উৎপাদনে আসতে দেড় থেকে দু’বছর সময় লেগে যায়। এজন্য এই কর সুবিধা সাধারণত বিনিয়োগকারীরা পান না। যেমন- চলতি কর বছরে হাসপাতাল স্থাপনে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। শুধু একটি মাত্র হাসপাতাল এই সুবিধার জন্য আবেদন করেছে। এ ধরণের সুবিধা কমপক্ষে তিন কর বছরের জন্য দেওয়া হলে এর সুফল মিলবে;
আগাম কর রিফান্ড ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রস্তাব করছি। সহজে ও দ্রুততম সময়ে রিফান্ড পেলে মানুষের মধ্যে কর দেওয়ার আগ্রহ বাড়বে; দিনে দিনে এনবিআরে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এর সঙ্গে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে যুযোপযোগী করতে হবে। দেশে ইটিআইএনধারীর সংখ্যা ৮৬ লাখের মতো। এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন মাত্র ২৮ লাখ। বাকি ইটিআইএনধারীদের রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে;
হয়রানি ও দুর্নীতিমুক্ত রাজস্ব প্রশাসন গড়ে তুলতে শতভাগ ডিজিটাল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উপর জোর দিতে হবে। করদাতা ও কর কর্মকর্তার সরাসরি সাক্ষাত যতোটা সম্ভব দূর করার চেষ্টা করতে হবে; ২০০৮, ২০০৯ সালে এনবিআর থেকে সরবরাহ করা ইসিআর মেশিনগুলোও সঠিকভাবে ব্যবহার হয়নি। একইভাবে গত কয়েক বছর ধরে এনবিআর যেসব ইএফডি মেশিন সরবরাহ করেছে, ভ্যাট ফাঁকি দিতে ব্যবসায়ীরা তাও ঠিকমতো ব্যবহার করছে না বলে জানা যায়। এ অবস্থায় আইএমএফ এর সঙ্গে স্বাক্ষরিত মেমোরেন্ডাম অব ইকোনমিক এন্ড ফিসক্যাল পলিসিতে ২০২৬ সালের মধ্যে আরও বেশি ইএফডি মেশিন সরবরাহ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে এনবিআর।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বাস চালু বাধ্যতামূলক করা এবং ব্যক্তিগত পরিবহনে শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়া নিষিদ্ধ করা। এসব বাস আমদানীতে করমুক্ত সুবিধা প্রয়োজন। এতে ঢাকার যানজট হ্রাস পাবে; পর্যটন ভিসায় আগত যেসব বিদেশি নাগরিক ঘন ঘন এসে বাংলাদেশে অবৈধভাবে কাজ করে, তাদের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। এজন্য ইমিগ্রেশনের সঙ্গে এনবিআর যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
বর্তমান আইন অনুযায়ী কাঁচামাল বা পণ্য আমদানির সময় ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে উৎসে কর কাটা হয়। এটি পরবর্তীতে সমন্বয় করে এনবিআর। তবে পণ্য বিক্রি করে কর সমন্বয়ের আগ পর্যন্ত ব্যবসায়ীর বড় আকারের মূলধন আটকে যায়। এভাবে ব্যবসার মূলধন আটকে না রেখে অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতিতে কর আহরণ করা যায়। সেই সাথে কোনো ব্যবসায়ী যেনো কর ফাঁকি দিতে না পারেন সেজন্য এনবিআরের পূর্ণ অটোমেশন প্রয়োজন;
রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের দক্ষতা অর্জনে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব করছি। বিশেষত আইন, অ্যাকাউন্টিং এন্ড ফাইন্যান্স, কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং, ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং বেস্ট প্র্যাকটিস, আইটি বিষয়ে অধিকতর দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষন বাড়ানো প্রস্তাব করছি; রাজস্ব বোর্ডের গবেষণা সেলটি আরও কার্যকর, শক্তিশালী ও যুগোপযোগী করার প্রয়োজন । একজন সদস্যের নেতৃত্বে গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে শক্তিশালী করা যেতে পারে। এই সেল থেকে সাংবাদিকদের তথ্য প্রাপ্তি সহজ করতে হবে;
২০১৩ সালে প্রণীত ট্রান্সফার প্রাইসিং আইনের প্রয়োগ নেই। পাচার করা অর্থ দেশে আনার জন্য এবারের বাজেটে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার সুফলও মিলছে না। এ অবস্থায় মুদ্রা পাচার রোধে ভারত, চীন অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মত কঠোর আইন প্রণয়নের সুপারিশ করছি; এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনের সমন্বয়ে একটি ট্যারিফ পলিসি করা হয়েছে। তবে ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু এনবিআরের। কোন খাতের জন্য ট্যারিফ কেমন হবে, কিভাবে রেশনালাইজ করা উচিত তা আউট লাইন করা রয়েছে ওই পলিসিতে। স্থানীয় শিল্পের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কি কি সুবিধা দেয়া উচিত তা নির্ধারণ করে ট্যারিফ পলিসিটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা;
তৈরি পোশাক শিল্পের মতো অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্যও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু করা। আংশিক রপ্তানিকারকদেরও পরীক্ষামুলকভাবে এ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এতে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ সম্ভব হবে। তবে এক্ষেত্রে বন্ড সুবিধা প্রাপ্তরা প্রকৃতপক্ষে রপ্তানি করেছে কি-না, তা যাচাই করা; পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এনবিআর সাধারণ কারখানা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের মধ্যে কর্পোরেট করের ব্যবধান কমপক্ষে ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে; বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সম্পদ কর আরোপের দিকে জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশে সম্পদের উপর সারচার্জ বিদ্যমান আছে। তবে তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন; পর্যটন খাতে বিকাশের স্বার্থে পর্যটকদের ভ্রমনের আকর্ষণ করতে বিভিন্ন ধরনের ছাড় দেওয়া দেওয়া যেতে পারে। ভারত এবার তাদের বাজেটে ‘দেখো আপনা দেশ’নামে একটি বিশেষ স্কিম হাতে নিয়েছে। এই স্কিমের আওতায় বিভিন্ন পর্যটন খাতে পর্যটকদের ছাড় দিয়ে উৎসাহিত করা হবে; প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দেশে উৎপাদিত সব ধরণের বিড়ি, সিগারেট ও জর্দ্দা-গুলের উপর শুল্ককর বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে অবৈধভাবে সিগারেট আসার পথ বন্ধ করা জরুরি।