নিজস্ব প্রতিবেদক : অর্থনীতিতে বাজার ব্যবস্থার কার্যকারীতার যথাযত উপলব্ধি করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তা নাহলে অর্থনীতিতে এর প্রভাব গভীরভাবে পড়বে। অপরিবর্তিত সুদের হারের কারণে দেশের সব সেক্টর মুনাফা হারানোর ঝুঁকির মুখে আছে বলে মন্তব্য করেন ড. আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ।
ভারতে উদার বিনিয়োগ হার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন তাদের ব্যালেন্সশীটে তেমন কোন চ্যালেঞ্জ দেখা যায়নি, মুদ্রাস্ফীতি তুলনামূলক কম। আমাদের দেশে পলিসিগত সমন্বয় থাকা দরকার। বৈশ্বয়িক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্নিত হওয়ার পরও আমাদের দেশে নিজেদের মতো করে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সুদের হার নিয়মিত পরিবর্তন করে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। বর্তমানে, মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট ও তারল্য সংকটই দেশে মূল সমস্যা। দেশে ডলার সংকট প্রকট, তা যদি আরো বাড়তে থাকে তাহলে সমস্য আরোও জটিল আকার ধারন করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে যে চাপগুলো আছে তা প্রশমনে দৃশ্যগত নীতিমালা ও দিক নির্দেশনা থাকা দরকার বলে তিনি মনে করেন।
ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি) ২৯ জানুয়ারী, আইসিএবি কাউন্সিল হল, সিএ ভবন (৮ম তলা), কাওরান বাজার, ঢাকায় মুদ্রানীতি ২০২২-২০২৩ এর উপর একটি গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ; ফেরদৌস আরা বেগম, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও), বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড); মাহবুব আহমেদ, সাবেক সিনিয়র সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়; ড. জামালউদ্দিন আহমেদ এফসিএ, সাবেক প্রেসিডেন্ট –আইসিএবি; মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা, সভাপতি, দ্য ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম ( ইআরএফ) এবং দৈনিক সমকালের বিজনেস এডিটর জাকির হোসেন আলোচনায় বক্তব্য রাখেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন আইসিএবি কাউন্সিলের সদস্য ও সাবেক সভাপতি মোঃ হুমায়ুন কবির এফসিএ।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইসিএবি ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ইয়াসিন মিয়া এফসিএ, ভাইস প্রেসিডেন্ট এমবিএম লুৎফুল হাদী এফসিএ, কাউন্সিল সদস্য ও সাবেক সভাপতি মোঃ কামরুল আবেদীন এফসিএ, কাউন্সিল সদস্য সাব্বীর আহমেদ এফসিএ, ফৌজিয়া হক এফসিএ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশীষ বসু এবং চিফ অপারেটিং অফিসার মাহবুব আহমেদ সিদ্দিকী এফসিএ।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে অপরিবর্তিত নীতি সুদের হার সমস্যাকে আরো জটিল করেছে। বৈশ্বয়িক বিবেচনায় ডলার সাথে টাকার বিনিয়োগ হার এর সমঞ্জস্য থাকতে হবে । অর্থ পাচার দেশে বড় আকার ধারণ করেছে। সঞ্চয় হার ৫.৫ শতাংশে নেমে এসেছে, যেটি আগে ছিল ১৬.৫-১৬.৭ শতাংশ। ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাষণ খুবই জরুরী। মুদ্রানীতিতে কোন ধরনের অসামঞ্জস্যতা থাকা যাবে না। বিনিয়োগ হার আন্তর্জাতিক বাজার ভিত্তিক করতে হবে এবং স্থিরতা বজায় রাখতে হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
আলোচনার সঞ্চালক মো. হুমায়ন কবির এফসিএ একজন অর্থনীতি্বিদ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বৈশ্বয়িক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে মুল্যস্ফীতি হয়েছে। তাই সুদের হারের ক্যাপ উঠিয়ে দিলেই চলমান সংকট দুর হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আইসিএবি প্রেসিডেন্ট মো. মনিরুজ্জামান এফসিএ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে তার মুদ্রানীতি (এমপিএস) ঘোষণা করেছে: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মোট দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি। এমপিএস ২২-২৩ অর্থবছরে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫.৬% হবে বলে প্রজেক্ট করে। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবণতা এবং ২০২৩ সালের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এটি আশাব্যঞ্জক। তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি রোধে বাজারে অর্থের সরবরাহ কমানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে, জাতীয় বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭.৫% ধরা হয়েছে। পলিসি রেট হিসেবে বিবেচিত রেপো সুদের হার বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমদানি বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ কারণে নতুন পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিলাস দ্রব্য, বিদেশী ফল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি রোধে মুদ্রানীতিতে এলসি মার্জিন বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে ।
তিনি আরও বলেন, নিয়ন্ত্রণহীন সুদের হার আমদানি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল করতে সহায়তা করবে।
বাজারে অর্থ সরবরাহ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫.৫০% করেছে। অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করতে এবং একই সাথে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন করার আশায় এবং অর্থনীতির উৎপাদনশীল এবং কর্মসংস্থানে প্রয়োজনীয় তহবিলের প্রবাহ নিশ্চিত করতে ৯% এর ঋণের হার ক্যাপ প্রত্যাহারের পরামর্শ দিচ্ছেন- বলে জানান তিনি।
মুদ্রানীতি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে আইসিএবি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকতা শুভাশীষ বসু বলেন, দেশে চলমান মুদ্রানীতি কমানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মোট দেশেজ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বার্ষিক মুদ্রানীতি ঘোষণা প্রণয়ন করে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বাড়ানোই মুদ্রানীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
দৈনিক সমকালের বিজনেস এডিটর জাকির হোসেন বলেন, সুদের হার যদি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় তাহলে মুদ্রানীতি ফলপ্রসূ পতে পারে না। এতে করে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। অবশ্য এই নির্দিষ্ট সুদের হার পর্যায় ক্রমে উঠিয়ে নেওয়া হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক ইঙ্গিত দিয়েছে। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীন উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে পারলে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে এখন আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তা কমানোর কোন সম্ভাবনা নেই। তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে সার্বজনীন মুদ্রানীতি প্রণয়নে মনোযোগ দিতে হবে।
মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধা বলেন, মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। কারণ কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পতে দেশে অধিক সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান জড়িত। বৃহৎ শিল্পের পাশাপাশি এই শিল্পের বিকাশ না হলে দেশে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। চলমান অর্থনৈতিক সংকটে বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীরা তাদের মুনাফা কমিয়ে দিয়েছে সেখানে আমাদের দেশের মুনাফা তারা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাজার তদারকিতে কোন নজরদারী নেই। সরকারের নীতিতে নিয়ন্ত্রণ কৌশল থাকা উচিত। শুধু মাত্র মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা সম্ভব নয়।
ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, দেশে বেসরকারী বিনিয়োগের তুলনায় সরকারী বিনিয়োগ বেশি। সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগ সমানতালে বৃদ্ধি হলে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মুদ্রানীতিতে তথ্য ও পলিসি সম্পাদনের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সামঞ্জস্যপূর্ণ বর্তমান অর্থনীতির পরিস্থিতির বিবেচনায় দিক নির্দেশনা এই ষোষিত মুদ্রানীতে দেখা যাচ্ছে না। তবে মুদ্রানীতির ৩ মাস পর পর প্রণয়ন করা দরকার যাতে করে অর্থনীতিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা যায়।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, চলমান সংকট মোকাবেলা করার জন্য পলিসিগত দিক নির্দেশনা থাকা দরকার। ষোষিত মুদ্রানীতি হতে হবে প্রয়োগিত ও কার্যকরী। বর্তমান মুদ্রানীতিতে নির্বাচনী বছরের অর্থ সরকবরাহের বিষয়টি আসেনি। সরকারের সকল নীতির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মাহবুব আহমেদ বলেন, ব্যবস্থাপনার দিক থেকে মুদ্রানীতি ছয় মাস পর পর প্রণয়ন করা যুক্তি সঙ্গত। বর্তমানে সুদের হার ও মুদ্রাস্ফীতির হার এর চেয়ে নীচে। যেটি অর্থনীতির জন্য স্বাভাবিক নয়। দেশেজ উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তবে এটা ভালো যে বর্তমান মুদ্রানীতি বৈষ্যয়িক অর্থনীতি পরিস্থিতি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছে। তবে বর্তমান মুদ্রানীতির বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির হার কমানো। তারল্য সংকটে ও বিনিয়োগ হার মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক সুদরে হার পূন বিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছে। যেটি আপাতত দৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে ব্যাংকিংখাত ও খোলাপী ঋণের জায়গাতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। বর্তমানে গড় জিডিপি হার খুবই কম ৭.৫ শতাংশ। এটি অবশ্যই বাড়াতে হবে। রাজস্ব আহরণ বাড়লেই সমস্ত পলিসি কার্যকর করা সম্ভব হবে।