৪১ বছরে পা রাখছে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক আইএফআইসি। ১৯৭৬ সালে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে এসে সরকার এটিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংক হিসেবে অনুমোদন দেয়। ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা এবং এ খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার।
প্রশ্ন: আইএফআইসি ব্যাংকের ৪০ বছর পূর্ণ হলো। পুরোনো এ ব্যাংকটির বর্তমান অবস্থা কী?
শাহ আলম সারওয়ার: বাংলাদেশের প্রাচীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংক একটি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেনের সুবিধার্থে এটি চালু করা হয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আস্থা, দক্ষতা বাড়ার পাশাপাশি একধরনের স্থবিরতাও বিরাজ করে। কয়েক বছর ধরে আমরা চেষ্টা করেছি স্থবিরতা কাটিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে সত্যিকার অর্থে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে। এটি করতে গিয়ে ব্যাংকের অভ্যন্তরে আমরা ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাগত অনেক পরিবর্তন এনেছি। চার বছর আগে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই একটি বিজনেস মডেল তৈরি করেছিলাম। তার ভিত্তিতে পরিবর্তনগুলো করা হচ্ছে। এখন আমাদের লক্ষ্য ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে আমরা চাই দীর্ঘমেয়াদি টেকসই প্রবৃদ্ধি। সে জন্য নতুন নতুন পণ্য বাজারে আনার পাশাপাশি সেবার মান বাড়ানোও আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। এককেন্দ্রিক সেবা বা ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করেছি। আমরাই প্রথম সহজ শর্তে ও কম সুদে গৃহঋণ সেবা চালু করেছি, যা এখন সবাই অনুসরণ করছে। আমাদের গৃহঋণ সেবাটি গ্রাহকদের মধ্যেও ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। আগামী দিনেও আমরা এমন কিছু সেবা চালু করতে চাই, যা দেখে অন্যরাও এগিয়ে আসবে।
প্রশ্ন: ব্যাংক খাতে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে। আপনি কী মনে করেন?
শাহ আলম সারওয়ার: বাংলাদেশে যতগুলো ব্যবসায়িক খাত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত একটি খাত ব্যাংক। দেশের অন্যান্য খাতের যে অবস্থা, তার তুলনায় ব্যাংক খাতকে খারাপ বলা যাবে না। ব্যাংক খাত অন্য খাতের চেয়ে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত বলেই কেলেঙ্কারির ঘটনাগুলো বেরিয়ে এসেছে। অনেক খাতে এ ধরনের কেলেঙ্কারির কথা জানাও যায় না। যখন একটি ইকোনমি বা দেশের অর্থনীতি উন্নতির পর্যায়ে থাকে, তখন অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। সেগুলোকে তাই অনেক সময় প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সহগামী হিসেবে ধরে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যখন ওয়েলস ফার্গো, আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, জেপি মরগ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সেখানে যে নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি ছিল, তার চেয়ে কম চ্যালেঞ্জে আছি আমরা। তবে এ কথাও সত্য, আমরা এখন এক পরিবর্তিত আধুনিক বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে আছি। এখানে ঘটনাগুলোকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করছি এবং আইনগত ব্যবস্থাটা কীভাবে নিচ্ছি, সেটা দেখার বিষয়। এ ছাড়া একটি দেশের যেকোনো খাত দেশটির সাংস্কৃতিক ও নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ওই বাস্তবতার বাইরে গিয়ে আলাদাভাবে কোনো খাতকে বিবেচনা করা সঠিক হবে না।
প্রশ্ন: কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটার পর আইনগত যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো যথাযথ ছিল?
শাহ আলম সারওয়ার: এ বিষয়ে আমি সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য করব না। তবে বিশ্বের উন্নত দেশে ঋণখেলাপি, দেউলিয়ার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সজাগ আইনকানুন আছে। সেই তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। বাইরে যখন কেউ ঋণ নিতে যান, তখন তাঁর বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের একটা ক্রেডিট রেটিং করা হয়। সেটা জাতীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ক্রেডিট অ্যানালাইসিস করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যখন কাউকে ঋণ দিতে যাই তখন তাঁর সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ও যথাযথ কোনো তথ্য আমাদের কাছে থাকে না। তখন ব্যক্তিগত চেনাজানা, বুদ্ধি–বিবেচনাবোধকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিতে হয়। এটা একটা সমস্যা। এ ছাড়া উন্নত বিশ্বে খেলাপি ঋণ আদায়ে সময় বেঁধে দেওয়া আইনগত কিছু বিধিবিধান আছে। আমাদের দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই। এসব বিষয়ে আমাদের ঘাটতি আছে।
প্রশ্ন: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আমাদের দেশে ব্যাংক খাতে এখনো বেশ আইনি দুর্বলতা রয়েছে?
শাহ আলম সারওয়ার: একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গেলে অর্থের নিরাপত্তা, খেলাপি ঋণ উদ্ধারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও অনেক উন্নতি করার প্রয়োজন আছে। আমেরিকার মতো দেশে কেউ যদি ক্রেডিট কার্ড খেলাপি হন, তাহলে সারা জীবন তাঁকে সে জন্য ভুগতে হয়। কোথাও কিছু করতে পারেন না। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা নেই। আমরা এখন বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত হয়ে গেছি। তাই নিয়ন্ত্রণমূলক ও আইনগত ব্যবস্থাগুলোও বৈশ্বিক ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করতে হবে।
প্রশ্ন: সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ব্যাংক খাতে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বড় কিছু ঘটনাও দেখলাম। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?
শাহ আলম সারওয়ার: সাধারণত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা দুই ধরনের হয়। যখন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তখন সেটির কিছু অভিন্ন ও সাধারণ ঝুঁকি থাকে। পাশাপাশি প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়। সাইবার অপরাধ আর্থিক খাতের জন্য নতুন একধরনের ঝুঁকি। এ ধরনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের অত্যন্ত সজাগ থাকা দরকার। এ ঝুঁকি মোকাবিলায় নিয়ন্ত্রণমূলক ও আইনগত কিছু ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ব্যাংক পরিচালনায় এখন যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাই তাঁদের অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতেই হবে।
প্রশ্ন: ব্যাংক খাতের সার্বিক ও আপনার নিজের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে জানতে চাই?
শাহ আলম সারওয়ার: আমার ব্যাংকে দু–তিনটি হিসাব আছে খেলাপি ঋণের। সেগুলো আমাদের কাছে চিহ্নিত। সেসব হিসাবকে আমরা বিশেষ তদারকির মধ্যে রেখেছি। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের যে অবস্থা তৈরি হচ্ছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সময় বেঁধে দিয়ে এসব ঋণ আদায়ের আইনগত ভিত্তি মজবুত করতে হবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ঋণ দেওয়ার আগে অ্যাসেসমেন্টটা আরও বেশি উন্নত করতে হবে। কাকে ও কোথায় ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেটির ঝুঁকি সম্পর্কে আগেই নিশ্চিত হওয়া জরুরি। খেলাপি ঋণ কমাতে হলে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো।