স্বাস্থ্য ডেস্ক: ভিটামিন-ডি সৌরলোকের ভিটামিন নামে পরিচিত। কারণ এটা সূর্যের আলো থেকে আমরা পাই। ক্যালসিয়ামের মাধ্যমে শরীরে হাড় গঠন, মজবুত শরীর গঠনে এর ভুমিকার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্ত ২০০০ সালের গুরুর দিকে শরীরে ভিটামিন-ডি এর অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এবং এখনো গবেষণা চলছে।
এরকমই কিছু গবেষণায় ফলাফল তুলে ধরার চেষ্টা করছি আজকের লেখায়-যা আমাদের কোভিড-১৯ সহ বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে। এখানে যে বিষয়গুলো তুলে ধরবো তা সবই আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল। অতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা এখানে স্বীকৃত হয়নি। বরং কিছু চিকিৎসা যা আগে কার্যকর বলে ধরা হতো তা পরবর্তীতে ক্ষতিকর বলে দেখা গেছে।
এমতাবস্থায় এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগতে পারে। বেশ কিছু ভিটামিন ও Trace elements আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে যা আমাদের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে সম্পূরক ভিটামিন-ডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও Respiratory Infection বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। আর কোভিডের ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ব্যথা নিরাময়ে ভিটামিন-ডি
ব্যথা নিরাময়ে ভিটামিন-ডি এর গুরুতপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সাম্প্রতিকালের গবেষণায় এ বিষযটি আলোচিত হয়েছে। আমাদের মধ্যে যারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ব্যথার সমস্যায় ভুগছেন, তাদের এই ব্যথার মূল কারণ বিভিন্ন অঙ্গে প্রদাহজনিত সমস্যা। ভিটামিন-ডি সাধারণভাবে এই প্রদাহজনিত সমস্যা কমিয়ে দেয়। এছাড়াও যারা ডিজেনারেটিভ ডিস্ক সমস্যার কারণে কোমর ব্যথায় ভূগছেন, তাদের হাড় ও ডিস্কে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের ঘনত্ব ঠিক রাখতে ভিটামিন-ডি এর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রযেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যারা নিয়মিত ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট নিচ্ছে তাদের ব্যথার সমস্যা কম। তাই, দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন-ডি সঠিকমাত্রায় গ্রহন করা জরুরী।
ভিটামিন-ডি কীভাবে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করতে পারে :
আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে শ্বাসতন্ত্রের কোষের উপর ভিটামিন-ডি এর প্রভাব রয়েছে যা ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন রোধে ভূমিকা রাখে। যে কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে ঢুকলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের অন্যতম উপাদান ম্যাক্রোফেজ যাকে আমরা পুলিশ বাহিনীর সাথে তুলনা করতে পারি, তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে ভিটামিন-ডি এই ম্যাক্রোফেজকে আরো সক্রিয় করে দেয়, যাতে তারা দ্রুত রেসপন্স করে।ভিটামিন-ডি ম্যাক্রোফেজ এর পরিপূর্ণ গঠনে সাহায্য করে।
ভিটামিন-ডি আমাদের শরীরে ক্যাথেলিসিডিন নামক একটি প্রোটিন এর সংখ্যা বৃদ্ধি করে, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আমাদের শ্বাসতন্ত্রকে যক্ষার জীবাণু, বিভিন্ন গ্রাম পজিটিভ, গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন-ডি এর অভাবে ইনফ্লেুয়েঞ্জা ও এ জাতীয় অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বেড়ে য়ায়। যা পরবর্তীতে অ্যাজমার ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যদি সম্পূরকভাবে ভিটামিন-ডি দেয়া হয় তাহলে Acute Respiratory Infection বা শ্বাসতস্ত্রের সংক্রমণের হার কমিয়ে দেয়।
বয়স্কদের উপর ভিটামিন-ডি এর প্রভাব:
বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন-ডি বয়স্কদের মৃত্যু হার কমিয়ে দেয়, যারা সাধারণত কোভিট-১৯ সহ বিভিন্ন শ্বাস ক্রেমণের ঝুঁকিতে থাকেন। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এ রকম কোনো প্রমাণিত তথ্য নেয় যে, ভিটামিন-ডি আপনাকে কোভিড ১৯ থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু ভিটামিন-ডি এর অভাবে আপনার যে কোনো ধরনের ঝুঁকি বাড়বে এবং আপনাকে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পরে, যা বিভিন্ন বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত।
শিশুদের ভিটামিন-ডি এর প্রস্তাব:
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে দুগ্ধপোয্য শিশু থেকে বাড়স্ত শিশু সকল পর্যায়ে ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল শিশু মায়ের দুধ খায়, তাদের ভিটামিন-ডি এর দৈনিক চাহিদা ৪০০ আন্তর্জাতিক ইউনিট (আইইউ)। কিন্তু তারা যে পরিমাণ মায়ের দুধ খায় তাতে তাদের ঘাটতি থেকে যায়। এসব শিশুর ভিটামিন-ডি এর চাহিদা পুরণের জন্য ছয় মাস পর ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ ফর্মুলা দুধ দেয়ার কথাও বলেছে গবেষণাটি। এছাড়া বাড়ন্ত শিশুর দৈনিক চাহিদা ৬০০ আইইউ যা পুরণ করতে হলে তাদের দৈনিক ১০০০ মিলি দুধ খেতে হবে। এ কারণে তাদেরও ঘাটতি রয়ে যায়। গবেষণা বলছে তাদেরও ভিটামিন-ডি সম্পূরক ডোজ দরকার রয়েছে।
গর্ভবতীদের ভিটামিন-ডি এর প্রভাব:
গর্ভবতী মায়েদের ওপর ভিটামিন-ডি এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই গর্ভবতী মায়েদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে এ কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকেন তারা। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন-ডি এর দরকার। এছাড়া এদের প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম দরকার। আর ক্যালসিয়াম শরীরে প্রবেশের জন্য ভিটামিন-ডি এর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা,গেছে যে সকল গর্ভবতী মা ভিটামিন-ডি এর অভাবে থাকেন তাদের সন্তানের জম্মের পর শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার:
স্যামন ফিস, টুনা ফিস ও অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ, মানরুম, দুধ, ডিম, চিজ ইয়োগার্ট ইত্যাদি।
কী পরিমাণ ভিটামিন-ডি দরকার প্রতিদিন:
কী পরিমাণ ভিটামিন-ডি দরকার সেটা নির্ভর করে রক্তে কী পরিমাণ ভিটামিন-ডি রয়েছে। তবে আমাদের স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি ১০০০ থেকে ৪০০০ আএইউ ভিটামিণ-ডি সম্পূরকভাবে দৈনিক খাওয়ার কথা গবেষণায় প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যাদেরর রক্তে ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি রয়েছে তাদের আগে ঘাটতি পূরণ করা জরুরী। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি পূরণের জন্য কিছু দিন চিকিৎসকের পরামর্শ আনুযায়ী ভিটামিন-ডি খেতে পারি। বাজারে একাধিক কোম্পানির ভিটামিন-ডি রয়েছে। যেমন (Cap, Vital-D, Cap. D-Cap) এগুলো ক্যাপসুল হিসেবে পাওয়া যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এগুলো মাত্রা ঠিক করে খাওয়া যেতে পারে। এর সাথে অনেক সময় ক্যালসিয়ামও দরকার হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এগুলো সেবন করা ঠিক হবে না। যার যেটা দরকার সে অনুযায়ী চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেবেন।
পরিশেষে বলতে চাই, কোভিড-১৯ থেকে রক্ষার সুনিদির্ষ্ট কোনো ওষুধ নাই। সেক্ষেত্রে আমাদের এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা গড়ে তোলাই এতে আক্রান্ত হওয়ার আগে এর থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র হাতিয়ার। আর এজন্য আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে ভিটামিন-ডি কে আমরা বেছে নিতে পারি, যার বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল তুলে ধরলাম। সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন-এই প্রত্যাশা ।
লেখক : ডা: মোহাম্মাদ আহাদ হোসেন, এমবিবিএস,বিসিএস এমডি, এফআইপিএস (এন্ডিয়া) কনসালটেন্ট ও পেইন ফিজিশিয়ান।