(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ৩য় অংশ)
ইংরেজী অনুবাদের ফরোয়ার্ড
এন জি চক্রবর্তী।। এ্যকাউন্টিং এর উপর ফ্র্যা লুকা ডি প্যাসিওলি লিখিত ১৪৯৪ সনে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার ৫০০ বছর পরে ’দি প্যাসিওলি সোসাইটি’ তার একটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করে। রেনেসাঁ গণিতবিদ প্যাসিওলি’র বইটা তৎকালীন ভেনিসে প্রচলিত হিসাব পদ্ধতির উন্নতরুপ আর এটা তাঁর বৃহত্তর ’সুম্মা ডি এ্যারিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরশনি এট প্রপোরশনালিটা’ নামে যে বইটা রয়েছে এটি তার একটি ক্ষুদ্র অংশ। ৩০০ পৃষ্ঠার ’সুম্মা’ তৎকালীন সময় পর্যন্ত গণিত বিষয়ের সর্বাধুনিক বই। ’সুম্মা’তে অন্তর্ভুক্ত ব্যবসায়ী বা বণিকদের জন্য ২৬ পৃষ্ঠার হিসাবরক্ষণ নীতি ও পদ্ধতির বিবরণ রয়েছে । প্যাসিওলি তার এই ২৬ পৃষ্ঠা অংশের নামকরণ করেছেন ’ পার্টিকুলারিস ডি কম্পিউটিস এট স্ক্রিপচার্স’।
’সুম্মা’ বইটি দারুণ পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছে। ’ফিগার্স ইন প্রপোরশন: আর্টস সায়েন্স এ্যান্ড বিজনেস রেনেসাঁ’ নামে প্যাসিওলি’র জীবন ও কর্ম সম্মন্ধে এ্যডওয়ার্ড এ ফ্যানেল তাঁর একটি চমৎকার মনোগ্রাফ লিখেছেন, যা ১৯৯৪ সনে ইন্সটিটিউট অব চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস অব ইংল্যান্ড এ্যান্ড ওয়েলস প্রকাশ করেছে। তাতে তিনি বলছেন প্যাসিওলির ’সুম্মা’তে অনুপাতের যে অংকসমূহ দিয়েছেন তা রেনেসাঁকালীন সময়ের বিজ্ঞান, সৌন্দর্য্য ও ব্যবসায়িক প্রাত্যহিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়’। এটা প্যাসিওলি’র মত প্রতিষ্ঠিত জ্ঞাণী শিক্ষকের প্রণীত এমন একটি বই যা প্রকাশ করা যে কোন প্রকাশকের স্বপ্ন। কারণ, বইটি শিক্ষা-সহায়ক বলেই লাভজনক। প্রকাশক প্যাগানিনো ডি প্যাগানিনিকে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়। সুম্মা’র যে অংশটি এ্যাকাউন্টিং এর উপর তা এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সুম্মা থেকে ওই অংশটুকু পৃথক করে পরে তাকে আলাদাভাবে ছাপতে হয়। এ চটি বইখানি ১৫৪৩ খৃষ্টাব্দের মধ্যে নানা ভাষায় অনুদিত হয়ে উত্তর ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
প্যাসিওলি’র ’সুম্মা’ গাণিতিক জ্ঞানকেও সমৃদ্ধ করেছে। এ বইটি রেনেসাঁ সময়কালের পন্ডিতদেরও সাহায্য করেছে। তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মিলানের লডভিকো সরজা’র দরবারের জ্ঞাণীগুণীজন। পন্ডিত ও শিল্পীদের এ দলে ছিলেন স্থপতি ব্রামান্তি, গীতিকার জসকিন ডেস প্রেজ আর শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। প্যাসিওলি’কে তাঁর গণিত আর অনুপাতের জ্ঞান দিয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’কে সমৃদ্ধ করার জন্য বোদ্ধা মহল তাঁকে অনুরোধ করেছিল। পিয়েরো ডেলা’র আশ্রিতজন প্যাসিওলি এভাবেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র শিক্ষক হয়ে ওঠেন। এই পিয়েরো’র প্রভাব যেমন একদিকে প্যাসিওলি’র উপর আবার অন্যদিকে তেমনি গণিত ও অনুপাত বিষয়ে প্যাসিওলি’র প্রভাব লিওনার্দো’র উপর যা সমস্ত কাজে বিশেষত তাঁর ’লাষ্ট সাপার’ শিল্পকর্মের মধ্যে ফুটে উঠেছে। ’ডি ডিভাইন প্রোপর্শন’ নামে যে বইটি লিওনার্দো আর প্যাসিওলি’র যৌথ সৃষ্টি তার লেখক ছিলেন প্যাসিওলি আর তার সম্পূর্ণ অলংকরণ করেছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি।
’সুম্মা’র যে অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তা তার ভাষা। বইটিতে তখনকার পন্ডিতজনের ভাষা যে ল্যাটিন সে ভাষায় নয়, বরং তিনি ব্যবহার করেছেন রেনেসাঁকালীন ইতালিতে সাধারণ মানুষজনের যে মৌখিকভাষা সেই ভাষা। রেনেসাঁকালীন মহান জ্ঞানী বিদ্বান আর পন্ডিতদের কাছে নয় বরং তিনি চেয়েছিলেন পাথরখোদাইকারী, স্থপতি, ব্যবসায়ী, ব্যংকার এঁদের মত সাধারণ মানুষজনের কাছে পৌছাতে। ব্যবসাবানিজ্যসহ জীবনের সমস্ত কাজে অংকের জ্ঞান অপরিহার্য।
ইংরেজী অনুবাদের মত একটি বিশেষ ক্ষেত্রে জেরেমি ক্রিপস এর এই অনুবাদটি নুতন করে সংযোজিত হলো। ক্রিপসের এই অনুবাদ কর্মটি তিনি এমনভাবে করেছেন যাতে আধুনিকমনষ্ক মানুষের কাছে বোধগম্য হয়। ভাষাবিদ, হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক ও পেশাদার হিসাববিদ অধ্যাপক জেরেমি’র বিশ্বাস যে, প্যাসিওলি বিংশ শতাব্দীতে বেঁচে থাকলেও তাঁর বইখানা ঠিক এভাবেই লিখতেন। প্যাসিওলি তাঁর বইতে মেমোরেন্ডাম, জার্ণাল, লেজার বোঝানোর সময় যে আংশিক উদাহরণ টেনেছেন তা অধ্যাপক জেরেমি বিস্তারিত করে লিখেছেন। তৎকালীন ছাপাখানার সীমাবদ্ধতার জন্য প্যাসিওলি এাকাউন্টিং এন্ট্রির বেলায় শর্টহ্যান্ড ব্যবহার করেছেন একথা নিশিচতভাবে বলা যায়। হতে পারে যে এ অনুবাদখানা বিতর্কের জন্ম দেবে, তবে একথাও সত্য যে প্যাসিওলিকে বর্তমান সময়ে জীবন্ত করেছেন অধ্যাপক ক্রিপস। তিনি প্যাসিওলি’র বইটির শাব্দিক অনুবাদ না করে বইটির পেছনে যে লেখক সত্বাটি কাজ করছিল তাকে ধরতে চেয়েছেন। প্যাসিওলি’র এ বইটি পড়লে শুধুমাত্র যে হিসাবরক্ষণের কলাকৌশল বোঝা যায় তা নয়, রেনেসাঁকালীন সময়কে বোঝার জন্যও এটা সমানভাবে কার্যকর।
রেনেসাঁকালীন ইতালীতে যে বানিজ্য সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল তাতে প্যাসিওলি’র যে অবদান তাকে অনুধাবন ও উদযাপন করার জন্য প্যাসিওলি সোসাইটির তিনটি উদ্যোগের একটি হচ্ছে এ বইখানা প্রকাশ করা। প্যাসিওলি’র হিসাববক্ষণ বিষয়ক বইটির এ অনুবাদ ছাড়াও সোসাইটির উদ্যোগে ১৯৯০ সনে সাউথ-ওয়ের্ষ্টান পাবলিশিং এর সহায়তায় প্যাসিওলি’র জীবন ও কর্মের উপর ”আনসাং হিরো অব দি রেনেসাঁ” নামে একটা তথ্যচিত্রের ভিডিও নির্মান করে। এছাড়াও সোসাইটি ১৯৯৪ সনের জুন মাসে লুকা প্যাসিওলি’র জন্মস্থান ইতালীর সান্সিপলক্রো’তে একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়া’র আয়োজন করে।
আমরা আশা করি পাঁচশ বছর আগে হিসাব ও বানিজ্য বিষয়ে লুকা প্যাসিওলি’র স্পষ্ট আর হৃদয়গ্রাহী লেখা বইটির ব্যাখ্যাসহ জেরেমি ক্রিপস যে অনুবাদখানি করেছেন তা যেমন আমাদের কাছে তেমনি আপনাদের কাছেও সমাদৃত হবে।
ডেভিড ই. টিনিয়াস
উইলিয়াম এল. লুইস
দি প্যাসিওলি সোসাইটি
সিয়াটল, ওয়াশিংটন
ডিসেম্বর, ১৯৯৪
লেখক: এন জি চক্রবর্তী, গবেষক কোম্পানি ল, পেশাদার হিসাববিদ ও সহ প্রতিষ্ঠাতা, আইসিএসবি।