(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ২য় অংশ
গুগলের বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত লুকা প্যাসিওলি’র ছবি ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে:
ফ্রা লুকা বার্তোলোমিও প্যাসিওলি : জীবন ও কর্ম-বাংলা অনুবাদক।
লুকা প্যাসিওলিকে বলা হয়, রেনেসাঁ ম্যান। ইউরোপে রেনেসাঁ এসেছিল প্রথম ইতালীতে। রেনেসাঁ মানে নবজন্ম। আর নবজন্ম মানে চিত্তের সম্পুর্র্ণ স্বাধীনতার কারণে উৎপাদিত নুতন চিন্তা ও কর্মের দ্বারা সৃষ্ট নুতন জ্ঞান ও শিল্পরীতি। রেনেসাঁর উৎপত্তির কারন নানাজনে নানাকথা বলেন। আমার মনে হয়, রেনেসাঁ নামের গাছটির বীজ হল চিত্তের পূর্ণ স্বাধীনতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাগ্রহ অপেক্ষা হল সূর্যালোক আর রসদ হলো অর্থানুকুল্য। এ তিনটির স্বার্থ পরষ্পর বিরোধী, তাই এ তিনের মনিকাঞ্চনযোগ ইতিহাসে দুর্লভ। ভৌগলিক কারণে ক্রুসেডের সময় থেকে ভেনিস, ফ্লোরেন্স আর মিলান প্রভৃতি প্রজাতন্ত্র ইউরোপের প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠার ফলে অর্জিত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আর গ্রানাডার নাসিরিড সা¤্রাজ্যের সাথে প্রজাতন্ত্রগুলোর কুটনৈতিক ও বানিজ্যিক চুক্তির ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। তার সংগে নুতনের প্রতি সমাজের আকর্ষণ কুসংস্করাচ্ছন্ন হাজার বছরের ঘুম ভেঙ্গে ইতালীর বানিজ্যকেন্দ্রগুলো রেনেসাঁকে অনিবার্য করে তোলে। ইউরোপের অন্ধকার যুগ (৫ম থেকে ১৪’শ শতাব্দী) শেষে পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪), বোকাচ্চিও (১৩১৩-১৩৭৫) এঁদের আগমনের ফলে শুধুমাত্র ইতালীতে পরবর্তী মাত্র একশ’ বছরের মধ্যে বেশকিছু মনিষীর জন্ম হয়। বত্তিচেল্লি (১৪৪৫-১৫১০), লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি ( ১৪৫২-১৫১৯), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২), মেকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭), কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), মাইকেল এঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫৬৪), রাফায়েল (১৪৮৩-১৫২০) তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
লুকা প্যাসিওলি’র জন্ম ইতালীর তুসকানি প্রদেশের সান্সিপলক্রো’তে ১৪৪৫ থেকে ১৪৪৮ সনের কোন এক সময়। আর মৃত্যু ১৫১৭ সনের ১৯শে জুন তারিখে। যদি ধরি লুকা’র জন্ম ১৪৪৭ তাহলে তিনি লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি’র চেয়ে ৫ বছরের বড়। তাঁর বাবা ছিলেন বার্তোলোমিও প্যাসিওলি । তিনি বাল্যকালে তাঁর জন্মস্থানেই উচ্চ শ্রেণির ল্যাটিনের বদলে স্থানীয় ভাষাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। কথিত আছে তিনি সান্সিপলক্রো’র বেলফোচি পরিবারের সংগে ছিলেন। তিনি ১৪৬৪ খৃ: ভেনিসের এক ব্যবসায়ির তিন ছেলেকে পড়াতেন। সংগে নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে যান। তাঁর ওই ছাত্রদের প্রয়োজনে তিনি গণিতের বই লেখার কাজে হাত দেন। ১৪৭২-১৪৭৫ এর মধ্যে তিনি ফ্রান্সিসক্যান ফ্রাইয়ার হন আর সেই থেকে তাঁর নামের সাথে ’ফ্রা’ কথাটি যুক্ত হয়। পেরুজিয়া’তে তিনি ১৪৭৭ খৃ: অংকের বিভাগীয় প্রধান হওয়ার আগে সেখানেই ১৪৭৫ থেকে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৪৯১ খৃ: রাজার আদেশে তিনি তাঁর শিক্ষকতা বন্ধ করতে বাধ্য হন। ভেনিসে বসে তিনি তাঁর ৩০০ পাতার মূল বই ’সুম্মা ডি এ্যারিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরশনি এট প্রপোরশনালিটা’ লিখেন। এ বইয়ের মাত্র ২৬ পাতার অংশটিতে ডাবল এন্ট্রি বিষয়ক পার্টিকুলারিস ডি কম্পিউটিস এট স্ক্রিপচার্স। এ মূল বই ১৪৯৪ খৃ: প্রকাশ করেন। ১৪৯৭ খৃ: তিনি মিলানের ডিউক লুডভিকো ফোরজা’র আমন্ত্রনে সেখানে যান আর সেখানে ’লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র সাথে তাঁর দেখা হয় ও তাঁকে তিনি অংকশাস্ত্র শিক্ষা দেন। ফ্রান্সের দ্বাদশ লুই’এর কাছে মিলানের পতন হলে লিওনার্দো ও তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান। তারপর থেকে দুজনার পথ আলাদা হয়ে যায়। আর খুব সম্ভব তিনি তাঁর জন্মস্থানে ১৯শে জুন ১৫১৭ খৃ: মারা যান।
আমাদের লুকা প্যাসিওলিকে ’রেনেসাঁ পুরুষ’ বলা হয়। কারণ শুধুমাত্র এ নয় যে তিনি সেইকালে জন্ম নিয়েছিলেন। কারণ হচ্ছে তিনি নুতন জ্ঞানের কথা লিখে গিয়েিেছলেন আপামর মানুষের জন্য। কি সে নুতন জ্ঞান? হিসাববই রক্ষণ বিষয়ের প্রাথমিক পর্যায়ের ছাত্ররাও জানে সে কথা। তিনি পৃথিবীকে ’দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি’ বা ’ডাবল এন্ট্রি সিষ্টেম’ এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তার আগে কি এ বিষয়ে কেউ কিছু জানতনা? না, বিষয়টি তা নয়, জানত এবং ভেনিসে এর কিছু ব্যবহারও ছিল, তবে সে সিষ্টেমটা সুশৃ্খংল সুসংবদ্ধভাবে লিখিত ছিল না। প্রকাশকাল অনুযায়ী যদি তাঁর লিখিত সব বইগুলোকে তালিকা করি, তবে এরকম দাঁড়াবে:
১. ট্রাকটাটাস ম্যাথামেটিকাস এড ডিসিপুলোস পেরুসিনোস (অপ্রকাশিত, রচনাকাল ১৪৪৭-১৪৭৮, ভ্যাটিক্যান লাইব্রেরী কর্তৃক সংরক্ষিত। বিষয়: পণ্যসহ যেকোন বিনিময়, লাভ, ধাতু মিশ্রনের অনুপাত, বীজগণিতসহ বনিকের ব্যবহারে যা প্রয়োজনীয়)।
২. সুম্মা ডি এ্যারিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরশনি এট প্রপোরশনালিটা (স্থান ভেনিস, প্রকাশকাল ১৪৯৪। বিষয়: তৎকালীন উত্তর ইতালীতে প্রচলিত সমস্ত রকম ব্যবসায়িক অংক ও বীজগণিত। এ বইএর একটি অংশে হিসাবের দুতরফা দাখিলা পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ রযেছে)।
৩. ডি ভেরিবাস কোয়ান্টিটেটিস (অপ্রকাশিত, রচনাকাল ১৪৯৬-১৫০৮, বলোগ্না বিশ^বিদ্যালয় লাইব্রেরী কর্তৃক সংরক্ষিত। বিষয়: অংক ও তাসের কৌশল, আগুন মুখে পোরা, ধাঁ ধাঁ, কয়েনকে নাচানোর ম্যাজিক। এতে জানা যায় যে দ্য ভিঞ্চি ছিলেন ’বাঁ হাতি’। ঊনবিংশ শতাব্দীর অংকের এক পান্ডুলিপিতে এ বইএর উল্লেখ পাওয়ায় গণিতবিদ ডেভিড সিংমাষ্টার এটির পুনরাবিষ্কার করেন। ২০০৭ সনে বইটির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়)।
৪. জিওমেট্রি (ইউক্লিড এর ’এলিমেন্টস’ এর ল্যাটিন অনুবাদ। প্রকাশকাল ১৫০৯)
৫. ডিভিনা প্রপোর্শনি (ভেনিস, প্রকাশকাল ১৫০৯। এ পর্যন্ত এটার দুটো সংস্করণ আবিস্কৃত হয়েছে। বিষয় গোল্ডেন রেশিও ও স্থাপত্যশিল্পে এর ব্যবহার। লিওনার্দো এ বইএর অলংকরণ করেন।)
উপরোক্ত পাঁচটির মধ্যে দ্বিতীয়টি মানে ’সুম্মা ডি এ্যারিথমেটিকা, জিওমেট্রিকা, প্রপোরশনি এট প্রপোরশনালিটা’তে মোট ১০টি অধ্যায়ে প্রায় ৬০০ পাতা রয়েছে। তার মধ্যে নবম অধ্যায় ’পাটিকুলারিস ডি কম্পিউটিস এট স্ক্রিপচারিস’ নামে ২৬ পাতা জুড়ে যে আলোচনা রয়েছে তাইই হচ্ছে ’দ’ুতরফা দাখিলা পদ্ধতি’র বিবরণ। ভেনিসসহ উত্তর ইতালীতে তখনকার যে হিসাবব্যবস্থ্যা প্রচলিত ছিল তারই লিখিত উন্নতরুপ হল ’সুুম্মা’র এ অংশটি। প্রতিটি ডেবিটের তাৎক্ষণিক ক্রেডিট তৈরী হয় আর ক্রেডিটের ডেবিট তা প্রথম স্পষ্টভাবে তিনি লিখে গেছেন। শুধু তাই নয় সময়বৃত্তের শেষে যে লাভক্ষতি হিসাব, ব্যালান্সশীট, ট্র্যায়াল ব্যালেন্স এমনকি ব্যংক রিকনসিলিয়েশন ষ্টেটমেন্টএর গুরুত্ব ও তৈরীর কলাকৌশল পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন। গত ৫০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে ব্যবসাবানিজ্যে পর্বতপ্রমান জটিলতা বাড়া ও ক্রমাগতভাবে ডিজিটালইড হওয়া সত্বেও লুকা’র বর্ণিত দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতি আজো সমানভাবে কার্যকর। যদিও তিনি তাঁর বইতে ’ধারণাগুলো তাঁর নিজস্ব নয় বরং এগুলো ভেনিসের ব্যবসার প্রচলিত নিয়ম’ বলে স্বীকারোক্তি করেছেন। তা সত্বেও তিনি পিয়েরো ডেলা ফ্রান্সেসকার লেখা থেকে তাঁর ’সুম্মা’ বইটি আর ’দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি’র ’পাটিকুলারিস ডি কম্পিউটিস এট ািস্ক্রপচারিস’ অংশটি জর্জিও চিয়ারিনি থেকে নকল করে লিখেছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। যদিও তা ধোপে টিকেনি। প্রমানিত হয়েছে যে বর্ণনার সরসতা অজ¯্র্র উদাহরণ আর ভাষার সাবলীলতার গুণে তাঁর লেখাটিই মৌলিক হয়ে উঠেছে।
তাঁর জীবন ও কর্মের উপর ভিত্তি করে ’আনসাং হিরো অব দি রেনেসাঁ’ নামে একটি ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায় (আগ্রহীরা দেখে নিতে পারেন)। অধ্যাপক জেরেমি ক্রিপস সুম্মা’র অংশ ’পাটিকুলারিস ডি কম্পিউটিস এট ািস্ক্রপচারিস’ এর ইংরেজী অনুবাদ করেন। প্যাসিওলি’র স্মরণে ১৪৯৪ সনে প্রকাশের পাঁচশ’ বছর পুর্তি উপলক্ষে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে প্রতিষ্ঠিত ’দি প্যাসিওলি সোসাইটি’ সে বইটির অনুবাদ ১৯৯৪ সনে প্রকাশ করে। আর প্যাসিওলি’র জন্মস্থান সান্সিপলক্রো’তে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন ও তাঁর জীবনী ও কর্মের উপর ’দি আনসাঙ হিরো অব রেনেসাঁ’ নামে একটি প্রামান্য ভিডিওটি নির্মান করে।
১৫১৭ সনের ১৯শে জুন তারিখে তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন অংকের শিক্ষক। সারা জীবন তিনি অংকের সাধনা করেছেন আর ভেনিসের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে সহায়তা দিয়েছেন। অন্যসব বাদ দিলেও হিসাববিজ্ঞানে তাঁর অবদান অমর হয়ে থাকবে।
লেখক: এন জি চক্রবর্তী, গবেষক কোম্পানি ল, পেশাদার হিসাববিদ ও সহ প্রতিষ্ঠাতা, আইসিএসবি।
প্রিয় পাঠক, তৃতীয় অনুবাদটি আসছে আগামী শনিবার