বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। বাজেট আসন্ন। এবার বাজেট আলোচনায় সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে। এই আইনটির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন: নতুন আইনে ভ্যাট হার নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীরা মুখোমুখি অবস্থানে আছে। এই সম্পর্কে আপনার কী মত?
আহসান মনসুর: ভ্যাট হার নিয়ে ব্যবসায়ীরা যে উদ্বেগ দেখাচ্ছেন, তা পুরোপুরি অযৌক্তিক। এটা সম্পূর্ণ সরকারের বিষয়। ভ্যাট হার নিয়ে নয়; ব্যবসায়ীদের আলোচনা করা উচিত ব্যবসায় সহজে নিবন্ধন, রিটার্ন জমা, হয়রানি না হওয়া এসব নিয়ে। ব্যবসায়ীরা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভ্যাট আদায় করবেন মাত্র। ভ্যাট হার কত হবে, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কত ঠিক করা হচ্ছে, এর ওপরেই ভ্যাট হার নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া জনগণের ওপর সহনীয় হারে ভ্যাট আরোপ হচ্ছে কি না, সেটা ভ্যাট হার নির্ধারণের সময় বিবেচনা করা হয়। ২৬ বছর ধরেই ভোক্তারা ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে আসছেন। ব্যবসায়ীরা তা সংগ্রহ করছেন। ১৫ শতাংশ ভ্যাট দেওয়া নিয়ে ভোক্তারা কখনো আপত্তি করেছেন, এমন কথা কখনো শুনিনি। এই বছরের আগ পর্যন্ত এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যত আলোচনা হয়েছে, তাতে ভ্যাট হার-সংক্রান্ত বিষয়টি কখনো আসেনি। এখন হঠাৎ করে এটা নিয়ে কেন আলোচনা শুরু হলো? ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ থাকতেই পারে। সেটা হওয়া উচিত, তাঁরা কীভাবে সহজে নিবন্ধন দিতে পারেন, কীভাবে সহজে রিটার্ন দিতে পারেন। আবার সহজ কর পরিশোধ এবং হিসাব রাখার বিষয়টি নিয়েও তাঁরা আলোচনা করতে পারেন। এই ভ্যাট হার তো তাঁদের জন্য প্রযোজ্য না, ভ্যাট তো ব্যবসায়ীরা দেবেন না, দিলেও তা রেয়াত নিয়ে ফেলবেন। তাহলে কেন ভ্যাট হার নিয়ে কথা বলছেন? পৃথিবীর কোনো দেশেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে ভ্যাট হার ঠিক করা হয় না। ব্যবসায়ীদের উচিত হয়রানি যাতে না হন, সে জন্য করসেবা বৃদ্ধির জন্য এনবিআরকে উৎসাহিত করা। এই সেবা আদায় করা নিয়েও সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা আলাপ করতে পারেন।
প্রশ্ন: নতুন ভ্যাট আইন হলে ছোট ব্যবসায়ীরা হিসাব রাখতে পারবেন কি?
আহসান মনসুর: ছোট ব্যবসায়ীরা যথাযথ হিসাব রাখতে পারবেন না, এটা একদম যৌক্তিক। তাই ভ্যাটমুক্ত সীমা রাখা হয়েছে। নতুন আইনে এই সীমা ৩০ লাখ টাকা লেনদেনে ভ্যাট দিতে হবে না। ১৯৯১ সালের আইনে ওই সীমা থাকলেও ৩ শতাংশ টার্নওভার কর দিতে হয়। আগামী জুলাই থেকে ভারতে যে গুডস অ্যান্ড সেলস ট্যাক্স (জিএসটি) আইন হচ্ছে, সেখানে ভ্যাটমুক্ত সীমা ১০ লাখ রুপি। বাংলাদেশি মুদ্রায় তা ১২-১৩ লাখ টাকা। বাংলাদেশে ভ্যাটমুক্ত সীমা ভারতের দ্বিগুণের বেশি। বাংলাদেশে যে ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে, তাতে ভ্যাটমুক্ত সীমা অত্যন্ত বেশি। এটি আরও বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই। যাঁরা মনে করেন ভ্যাটের বাইরে থাকলে লাভবান হবেন, তাঁরা কখনো বড় হতে পারবেন না। ছোট হয়েই চিরকাল থাকতে হবে। বড় প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনবে না। আর টার্নওভার করের সীমা ৫ কোটি টাকা করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁরা তো রসিদ দিতে পারবেন না। বড় ব্যবসায়ীরা তাঁদের কাছ থেকে পণ্য কিনবেন না, রসিদ ছাড়া বড়রা রেয়াত নিতে পারবেন না। ছোট ব্যবসায়ীরা বড় কোম্পানির সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করেন, সেটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন: ভ্যাট হার কমালে কি কোনো সমস্যা হবে?
আহসান মনসুর: ভ্যাট হার কমালে আইনটি বাস্তবায়নের দিক থেকে কোনো সমস্যা হবে না। আমি মনে করি, ভ্যাট হার কমালে জনগণ তথা ভোক্তারা খুব বেশি উপকৃত হবেন না। পণ্য বা সেবার মূল্যহ্রাস হবে না। কিন্তু ১ শতাংশ ভ্যাট কমালে যে আট হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে, সেই টাকা চলে যাবে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে। ভোক্তারা কোনো সুবিধা পাবেন না। সরকারের এত রাজস্ব ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ১৫ শতাংশ ভ্যাট রেখে যখন উচ্চ হারে রাজস্ব আদায় হবে, তখন ভ্যাট হার কমানো যেতে পারে।
প্রশ্ন: ব্যক্তিশ্রেণি করমুক্ত সীমা বৃদ্ধি এবং করপোরেট কর কি কমানো উচিত? আহসান
মনসুর: ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত সীমা বাংলাদেশে অনেক বেশি। বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬০২ ডলার। আর করমুক্তসীমা আড়াই লাখ টাকা; অর্থাৎ প্রায় তিন হাজার ডলার। মাথাপিছু গড় আয়ের দ্বিগুণ আয় করলে বাংলাদেশে কর দিতে হয়। এতে করজালের বাইরেই থাকেন বেশির ভাগ মানুষ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ৫৫ হাজার ডলার হলেও করমুক্তসীমা মাত্র ৪ হাজার ডলার।
প্রশ্ন: কালোটাকা সাদা করার সুযোগ কি থাকা উচিত?
আহসান মনসুর: অপ্রদর্শিত ও বেআইনিভাবে অর্জিত টাকা সাদা করার সুযোগ থাকা উচিত নয়। তবে জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত বৈধ আয় ঘোষণায় আনার সুযোগ রাখা যেতে পারে। এটা অনেক দেশেই আছে। অর্থাৎ যে টাকা আয়ের উৎস দেখানো যাবে, সেটাই ঘোষণায় আনার সুযোগ থাকা উচিত।
সৌজন্যে: প্রথম আলো