মাহিদুল ইসলাম: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শীর্ষ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা অন্যান্য কর্মচারীদের তুলনায় অনেক বেশি হারে বেতন নিচ্ছেন। কিন্তু কোম্পানিগুলো বছরের পর বছর লভ্যাংশ দিতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোম্পানির এমডির বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা সম্পর্কে আলাদা কোনো তথ্য কোম্পানির প্রফিট অ্যান্ড লস একাউন্টে উল্লেখ করা হয়নি যা ইন্টরন্যাশনাল একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) ২৪ এর লঙ্গন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে লিজিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) প্রতিমাসে যে পরিমাণ আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত এবং কোম্পানিগুলোর মুনাফা বৃদ্ধি, ডিভিডেন্ট ঘোষণা এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে সাফল্যের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে এই রিপোর্টে।
আজ তুলে ধরা হলো বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত।
২০১৯ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম আশফাকুর রহমান চৌধুরির (এমডি) বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার সম্পর্কে কোনো তথ্য কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে দেওয়া নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতে পাওয়া যায়নি, যা ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) ২৪ এর লঙ্গন।
কোম্পানির প্রফিট অ্যান্ড লস একাউন্টে উল্লেখিত, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সবাই সমন্বিত বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। উক্ত বছর কোম্পানিটির নিট ক্ষতি হয়েছিল (১২২) কোটি (৮১) লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি লোকশান হয়েছিল (১২.২০) টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল (৯৪.২৭) টাকা। আলোচ্য বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
২০২০ সালেও কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম আশফাকুর রহমান চৌধুরির (এমডি) বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার সম্পর্কে কোনো তথ্য কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়নি, যা ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) ২৪ এর লঙ্গন।
কোম্পানির প্রফিট অ্যান্ড লস একাউন্টে উল্লেখিত, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সমন্বিত বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। উক্ত বছর কোম্পানিটির নিট ক্ষতি হয়েছিল (৮১) কোটি (৫২) লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি লোকশান হয়েছিল (৮.১০) টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল (১০২.৩৭) টাকা। উক্ত বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
এছাড়া ২০২১ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মি. মোহাম্মদ আনোয়ারুল্লাহ সাদেক (এমডির) বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার সম্পর্কে কোনো তথ্য কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীতে পাওয়া যায়নি, যা ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএএস) ২৪ এর লঙ্গন।
কোম্পানির প্রফিট অ্যান্ড লস একাউন্টে উল্লেখিত, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সমন্বিত বেতন ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ সর্বমোট নিয়েছেন ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। উক্ত বছর কোম্পানিটির নিট ক্ষতি হয়েছিল (৯৮) কোটি (৫০) লাখ টাকা এবং শেয়ার প্রতি লোকশান হয়েছিল (৯.৭৮) টাকা ও শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য ছিল (১০৬.৮৩) টাকা। সে বছরও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি।
২০১৯ সালে কোম্পানির লোন্স অ্যান্ড এডভান্স ছিল ৭৯৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা যা ২০২১ সালে হয়েছিল ৭৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিগত ৩ বছরে ২০১৯-২০২১ পর্যন্ত কোম্পানিটির লোন্স অ্যান্ড এডভান্স কমেছে ৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
পক্ষান্তরে, ২০১৯ সালে কোম্পানিটির ডিপোসিট ও অন্যান্য প্রাপ্তি ছিল ৫৮৯ কোটি ২২ লাখ টাকা যা ২০২১ সালে হয়েছিল ৬৮৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিগত ৩ বছরে ২০১৯-২০২১ পর্যন্ত কোম্পানিটির ডিপোসিট ও অন্যান্য প্রাপ্তি বেড়েছে ৯৪ কোটি ২ লাখ টাকা।
এছাড়া, ২০১৯ সালে কোম্পানিটির সংরক্ষিত ক্ষতি ছিল (১১০৪) কোটি (৯০) লাখ টাকা যা ২০২১ সালে লোকশান বেড়ে দাড়িয়েছে (১২৩১) কোটি (৩৮) লাখ টাকায়। অর্থাৎ বিগত ৩ বছরে ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির সংরক্ষিত ক্ষতি বেড়েছে ১২৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের তিন প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি লোকশান হয়েছে (৩.৪৪) যা ২০২২ সালে সমাপ্ত বছরে কোম্পানির শেয়ার প্রতি লোকশান হয়েছিল (৭.৫৮) টাকা, ২০২১ সালে যা ছিল (৯.৭৮) টাকা, ২০২০ সালে ছিল (৮.১০) টাকা, ২০১৯ সালে ছিল (১২.২০) টাকা।
২০২৩ সালের তিন প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমূল্য হয়েছে (১১৭.৮৫) টাকা যা ২০২২ সালে সমাপ্ত বছরে শেয়ার প্রতি নিট সম্পদমুল্য হয়েছিল (১১৪.৪২) টাকা, ২০২১ সালে যা ছিল (১০৬.৮৩) টাকা, ২০২০ সালে ছিল (১০২.৩৭) টাকা ও ২০১৯ সালে ছিল (৯৪.২৭) টাকা।
লভ্যাংশ সংক্রান্ত তথ্য পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, বিগত ১১ বছরেও কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীরে জন্য কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। তবে ২০১৩ সালে ৫ শতাংশ স্টক, ২০১২ সালে ৫ শতাংশ স্টক, ২০১১ সালে ১০ শতাংশ স্টক, ২০১০ সালে ২৫ শতাংশ স্টক ও ২০০৯ সালে ২২.৫ শতাংশ স্টক লভ্যাংশ দিয়েছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, কোম্পানিটি ৪০০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ২০০৬ সালে তালিকাভূক্ত হয়েছে। কোম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধনের পরিমান ১০০ কোটি ৬৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার ১০ কোটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৯৪৪ এবং রিসার্ভ অ্যান্ড সারপ্লাসে রয়েছে (১১৭৬) কোটি (২৯) লাখ টাকা।
ডিএসই’র তথ্য অনুযায়ি ২৮ ফেব্রয়ারি, ২০২৫ তারিখে উদ্যোক্তা পরিচালকের হাতে রয়েছে ৩৮.৩৫ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর হাতে রয়েছে ৪৩.২৭ শতাংশ শেয়ার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে রয়েছে ১৮.৩৮ শতাংশ শেয়ার।
তথ্য অনুসারে, গত বছর কোম্পানিটির শেয়ার দর উঠানামা হয়েছে ৫.৮০ টাকা থেকে ১২.৭০ টাকার মধ্যে। গতকাল সমাপনির ছিল ৬.৯০ টাকা এবং আজকের ওপেনিং দর ৭.১০ টাকা। ২০০৬ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে কোম্পানিটি বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে।
২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত ৩টি অর্থ বছরেই কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি (অব.) মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি (বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী) উচ্চ আদালত কর্তৃক নিযুক্ত চেয়ারম্যান এবং স্বাধীন পরিচালক। তিনি ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে কোম্পানি ম্যাটার নং ৩২/২০২০ অনুসারে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডে নিযুক্ত হন।
কোর্ট এপয়েন্টেড অন্যান্য পরিচালকরা হলেন মি. শামিম খালেদ আহমেদ (ডিরেক্টর), মি. মোহাম্মদ তোফাজ্জ্বেল হোসেইন, এফসিএ (ডিরেক্টর), মি. রুহুল আমিন, এফসিএমএ (ডিরেক্টর), মি. শ্যামল কান্তি ঘোষ (ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর), ড. মোহাম্মদ জামিল শরিফ, এফসিএমএ (ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর), মি. মোহাম্মদ মাহমুদ হোসেইন, এফসিএ (ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর), মি. ফখরুদ্দিন আহমেদ, এফসিএমএ,এফসিএ (ইনডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর), এ কে এম আশফাকুর রহমান চৌধুরি, এফসিএমএ (ম্যানেজিং ডিরেক্টর)।
২০১৯ ও ২০২০ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থপনা পরিচালক ছিলেন এ.কে.এম আশফাকুর রহমান চৌধুরী। তিনি (এ.কে.এম আশফাকুর রহমান চৌধুরী) ১ জুন, ২০২০ তারিখে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি)-এ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন এবং পরবর্তীকালে ১ জুলাই, ২০২০ তারিখ থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বর্তমান দায়িত্ব পালন করেন। বিআইএফসি-তে যোগদানের আগে, তিনি (এ.কে.এম আশফাকুর রহমান চৌধুরী) ২০০৭ সাল থেকে বিডি ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিংয়ের মতো বিভিন্ন এনবিএফআই-তে হেড অফ ফাইন্যান্স, হেড অফ অ্যাকাউন্টস, হেড অফ ট্রেজারি, কোম্পানি সেক্রেটারি, হেড অফ ব্রাঞ্চ এবং হেড অফ লায়াবিলিটি অপারেশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০২ সালে আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেডের মাধ্যমে আর্থিক খাতে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি দ্য ইনস্টিটিউট অফ কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশের একজন ফেলো সদস্য।
২০২১ সালে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মি. মোহাম্মদ আনোয়ারুল্লাহ সাদেক। তিনি (আনোয়ারুল্লাহ সাদেক) ৮ নভেম্বর, ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডে চট্টগ্রাম শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে তার চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে তিনি সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ৩ জুলাই, ২০২৩ সাল থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। বিআইএফসিতে যোগদানের আগে, তিনি ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেডে কাজ করেছেন। এনবিএফআই খাতে তার ২৩ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান তোহা আনোয়ার রউফ অ্যান্ড কোং, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি কোর্স সম্পন্ন করেছেন।
কোম্পানিটির ওয়েবসাইটে ২০১৯-২০২১ সাল পর্যন্ত বার্ষিক প্রতিবেদন দৃশ্যমান কিন্ত ২০১৯ সালের পূর্বে এবং ২০২১ সাল পরবর্তী ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ের বার্ষিক প্রতিবেদন গুলো কোম্পানির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। অথচ কোম্পানিটি ২০০৬ সালে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত হয়েছে।
যেহেতু ২০১৯ সালের পূর্বের কোনো তথ্য কোম্পানির ওয়েবসাইটে উল্লেখ নেই। ২০২১ পরবর্তী ২০২২-২০২৪ সাল পর্যন্ত কোনো তথ্যও কোম্পানির ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়নি। কোম্পানির শুরু থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যান , ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় কোম্পানির আর্থিক প্যারামিটার নেগেটিভ ছিল। তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর অর্থ লোপাট করে তারা কিভাবে এখনো স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে এটাই শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের অভিমত।