নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা পরিষদে উন্নয়ন তহবিলের অর্থায়নে একাধিক প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। মোট ১৭টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভায় পরিচালিত এই প্রকল্পগুলির ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৫ কোটি টাকারও বেশি। তবে, প্রকল্পগুলির ওপর অভিযোগ রয়েছে।
অনেক প্রকল্প এমন সময়ে নির্বাচিত হয়েছিলো যখন পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতায় ছিল, এবং কিছু প্রকল্প একাধিকবার অনুমোদিত। পূর্বে বাস্তবায়িত সড়কগুলোর নামও পুনরায় তালিকাভুক্ত হয়েছে, যা প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, বেশ কিছু প্রকল্পের মধ্যে তহবিলের ব্যবহারের সঠিকতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্রনেতারা দাবি করেছেন, অনুমোদিত প্রকল্পগুলির বাজেট, পদ্ধতি এবং গুরুত্ব পুনরায় পর্যালোচনা করে, কিছু প্রকল্পের অযৌক্তিক কাটছাট বা পুনঃবণ্টন করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদকের হাতে আসা প্রাপ্ত পাঁচ পৃষ্ঠার তালিকা অনুযায়ী, ১৬৪টি প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪ কোটি ১ লাখ টাকার উপরে, তবে আরো ৩২টি প্রকল্পের তালিকা গোপন রয়েছে। তা যোগ হলে ব্যয় প্রায় ৫ কোটি টাকার অধিক। প্রকল্পগুলির মধ্যে ১.৫ লাখ টাকার প্রকল্প ২টি, ২ লাখ টাকার প্রকল্প ১৩৯টিরও অধিক, ৩ লাখ টাকার প্রকল্প ৩৩টি, ৪ লাখ টাকার প্রকল্প ৬টি, ৫ লাখ টাকার প্রকল্প ৪টি, ৬ লাখ টাকার প্রকল্প ৬টি।
তিনটি পদ্ধতির ভিত্তিতে এসব প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে। যেমন-পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপ্লেমেনটেশন কমিটি মানে প্রকল্প কমিটি), টেন্ডার, এবং আরএফকিউ (রিকুয়েস্ট ফর কোয়াটেশন) পদ্ধতিতে। তবে পিআইসি পদ্ধতিতে প্রকল্প বেশি। টেন্ডার পদ্ধতিতে কিছু প্রকল্পে পিআইসির একই পরিমাণ বরাদ্দে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত অনেকটা সাংঘর্ষিক বলেও মনে হতে পারে।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে ধর্মীয় স্থাপনা (মসজিদ, মন্দির), সড়ক উন্নয়ন, কবরস্থান ও ওয়াল নির্মাণ, ড্রেন ও কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭৩টি প্রকল্প ধর্মীয় স্থাপনার উন্নয়ন, ৯৭টি সড়ক উন্নয়ন, ২২টি কবরস্থান ও ওয়াল নির্মাণ, এবং ৬টি ড্রেন ও কালভার্ট নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তবে, অনেক প্রকল্পই সাধারণ মানুষের অজান্তে এবং ইচ্ছেমতো পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে আরসিসি (Reinforced Concrete Concrete), এইচবিবি (High Bitumen Concrete) এবং ব্রিক সলিং ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কিছু সড়ক প্রকল্প, যেমন ভুঁইয়া বাড়ি সড়ক পূর্বে সম্পন্ন হলেও একই সড়কের ভিন্ন নাম দিয়ে পুনরায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এতে সরকারি টাকার অপব্যবহার হতে পারে।
গত বছরে একই সড়কের নাম ছিলো বরলিয়া ভুঁইয়া বাড়ি রফিক আহমদ সড়ক। এবারের প্রকল্পে একই সড়কের নাম এসেছে এডভোকেট ফোরকানুল ইসলামের বাড়ি সড়ক। আগে ছিলো সড়কটি পিতার নামে, এখন পুত্রের নামে। সড়কটি গত বছরে, ১% স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর কর হতে প্রাপ্ত বরাদ্দে কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলেও কাহজপত্রে সত্যতা পাওয়া গেছে।
এছাড়া, কিছু প্রকল্পে মসজিদ, মন্দির, এবং অন্যান্য ধর্মীয় স্থান সংলগ্ন সড়ক উন্নয়নের নাম করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। যা অতিকতর যাচাই-বাছাই প্রয়োজন।
এতে ৪ লাখ টাকার প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম পূর্ব হাইদগাঁও আল আমিন জামে মসজিদ কবরস্থানে রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ (টেন্ডার), হাবিলাসদ্বীপ টি এল চৌধুরী সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন (টেন্ডার), হাবিলাসদ্বীপ লস্কর শাহ সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন (টেন্ডার), আশিয়া নতুন বাড়ি সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন (টেন্ডার), কুসুমপুরা বিনিনিহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন (টেন্ডার) অন্তর্ভুক্ত।
৫ লাখ টাকার প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম এয়াকুবদন্ডী নওয়াজী মুন্সী জানে মসজিদ ঈদগাহ মাঠ আরসিসি উন্নয়ন (টেন্ডার), জিরি পশ্চিম মালিয়ারা মাবিয়া ছমদ জামে মসজিদ সড়ক আরসিসি উন্নয়ন (টেন্ডার), কচুয়াই স্বপন ডাক্তারের বাড়ী শশ্মানে বাউন্ডারী ওয়াল ও সড়ক ব্রিক সলিং দ্বারা উন্নয়ন (টেন্ডার), দক্ষিণ ভূর্ষি পূর্ব ডেঙ্গাপাড়া জামে মসজিদ উন্নয়ন (টেন্ডার) রয়েছে।
৬ লাখ টাকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ধলঘাট করণখাইন খন্দকার পাড়া মুসলেহ উদ্দিন ভোলোয়ার বাংলা সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন ও রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ (টেন্ডার), শোভনদন্ডী কুরাংগিরী মধ্যম পাড়া মরহুম ছৈয়দ আলী বাড়ি ঘাটা সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন ও আবদুর রশীদের বাড়ি ঘাটা সড়ক এইচবিবি দ্বারা উন্নয়ন (আরএফকিউ), ধলঘাট ৩নং ওয়ার্ড করনখাইন মুসলিম পাড়া সড়ক হতে কালু শাহ সড়ক পর্যন্ত আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন (আরএফকিউ), ধলঘাট তেকোটা বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন শ্মশান সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন ও ওয়াল নির্মাণ (আরএফকিউ), খরনা ৪নং ওয়ার্ড আমজাদ আলী মাস্টার বাড়ী সড়কের পাশে প্যালাসাইডিং ওয়াল নির্মাণ (আরএফকিউ), ধলঘাট তেকোটা সন্ধমোদয় বিহারের পুকুরে রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ (আরএফকিউ), আশিয়া ৮নং ওয়ার্ড পূর্ব বাথুয়া দক্ষিণ বাড়ি সংযোগ সড়ক আরসিসি দ্বারা উন্নয়ন (আরএফকিউ) রয়েছে।
এই প্রকল্পগুলির মাঝে কিছু প্রকল্পের নির্বাচনে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার অভাব রয়েছে। একাধিক বার একই প্রকল্পের পুনর্নির্মাণ এবং সন্দেহজনকভাবে প্রকল্প বরাদ্দের প্রক্রিয়া দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে, কচুয়াই, শোভনদন্ডী, এবং খরনা ইউনিয়নে প্রকল্পের মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় এবং তাদের মধ্যে বৈষম্য বিষয়ক অভিযোগ উঠে এসেছে।
প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে আরও স্বচ্ছতা এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে প্রকল্পগুলি প্রকৃতপক্ষে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগে এবং দুর্নীতির স্থান না পায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পটিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এসব প্রকল্প সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। সম্ভবত সাবেক ইউএনও আলা উদ্দিন ভূঁইয়ার সাহেবের সময় এগুলো নেওয়া হয়। তখন আমাদের তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। জনস্বার্থে প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত, যাতে কাজের পুনরাবৃত্তি না হয়।’
পটিয়া উপজেলা বিএনপি আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবগত নই। আমাদের সেক্রেটারি খোরশেদ হয়তো কিছু জানেন। উনার সাথে কথা বলুন।’
পটিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব খোরশেদ আলম বলেন, ‘এসব প্রকল্প কীভাবে নেওয়া হলো, আমরা জানি না। ইউএনও সাহেব একাধারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্বে। আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াতও দেওয়া হয় না। উপজেলায় গেলে সমন্বয়কের নামে কিছু লোককে অফিসে বসে থাকতে দেখা যায়। প্রকল্পগুলো জনস্বার্থে নেওয়া হয়েছে কিনা, সেটাও আমার জানা নেই। কারণ এসব প্রকল্পে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই এবং প্রশাসন আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। প্রকল্পগুলো দেখে মনে হয় গতানুগতিক।’
উপজেলা প্রকৌশলী কমল কান্তি পাল বলেন, ‘আমরা সরাসরি প্রকল্প নিই না। সাবেক ইউএনও স্যারের সময় জনপ্রতিনিধিদের থেকে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। ৫ কোটি টাকা আছে কি না, তা যাচাই করতে হবে। একই প্রকল্প বারবার আসা সম্ভব নয়। অনিয়ম থাকলে ইউএনও অফিসে যোগাযোগ করুন।’
নবাগত উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ফারহানুর রহমান এর সরকারি মুঠোফোনে একাধিকবার কল এবং সমস্ত অভিযোগের আদ্যোপান্ত লিখে হোয়াটসঅ্যাপে মন্তব্য চাইলেও কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান জানান, ইউএনও সম্ভবত জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে মিটিং এ আছেন। যদি প্রকল্প নেওয়াতে কোন ধরনের অনিয়ম থাকে তাহলে তদন্ত করে যাচাই-বাছাই পুর্বক পুনঃবিবেচনার সুযোগ রয়েছে। জনস্বার্থে যেটি মঙ্গল হয় সেটাই করা হবে।’