মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সিইও।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট-এর মাস্টার্সে অধ্যয়নকালে বীমা আমার একটি সাবজেক্ট ছিল। তখনই জানতে পারি বীমা কি এবং কিভাবে ব্যক্তি ও সম্পদের জন্য কতটা কার্যকর। আমি ইন্টার্ণ পেপার জমা দেয়ার জন্য হাতে কলমে বীমা শিক্ষার জন্য আমার এক সহপাঠীর বড় ভাইয়ের সুবাদে প্রায় ০৩(তিন) মাস বীমার প্রপোজাল ফরম থেকে পুনঃবীমা সংক্রান্ত যাবতীয় শিক্ষা ১৯৮১ সনে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকে গ্রহণ করি।
পরবর্তীতে সি.এ. প্রফেশন থেকে কোর্স কমপ্লিট করে গ্রামীন ব্যাংকে ইন্টারনাল অডিট ডিপার্টমেন্ট-এ প্রায় ০২(দুই) বছর কাজ করার পর এক প্রফেশনাল বড় ভাইয়ের হাত ধরে ১৯৮৬ সালের ২৫শে মার্চ আমার বীমা শিল্পে আগমন। সি.এ. প্রফেশনে কাজ করার কারণে সৌভাগ্যক্রমে বড় এক বীমা কোম্পানীর পুনঃবীমা, দাবী, আন্ডার রাইটিং সকল বিভাগের সাথেই যুক্ত ছিলাম। সে সময় আমাদের মতো উচ্চ শিক্ষিত লোক বীমা শিল্পে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে। যারা ঐ সময়ে পেশাটাকে নেশা হিসাবে গ্রহণ করে আগ্রহ সহকারে বীমার জন্য নিবেদিত হয়ে গুরুর দীক্ষা নিয়ে ছিলেন এখন তারাই বীমা শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
শিক্ষিত ও পেশাগত দক্ষ লোকের অভাবেই বীমা শিল্প আজো কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছে না। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন এবং নন-লাইফ বীমা কোম্পানীগুলোতে বীমা জানা লোকের অভাবেই প্রতি নিয়ত বীমা, পুনঃবীমা, দাবী সকল ক্ষেত্রেই সমস্যা বিদ্যমান। এ অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে।
বর্তমানে আমাদের প্রচুর শিক্ষিত জনশক্তি রয়েছে এদের উদ্ভুদ্ধ করার কৌশল ও চাকুরীর নিরাপত্তা বিধান এবং ব্যাংকিং পর্যায়ের সম-পরিমান বেতন-ভাতা প্রদান, প্রশিক্ষণ ও বীমা ডিপ্লোমার মাধ্যমে এদের প্রশিক্ষিত করতে পারলে বীমা শিল্পের অবস্থার পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বেসরকারী বীমা কোম্পানী ১৯৮৫ সালের শেষভাগে যখন কার্যক্রম শুরু করে প্রায় তখন থেকেই আমি বীমা শিল্পের সাথে জড়িত। প্রাথমিক অবস্থায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশন বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলোকে বেশ সহযোগীতা করতো। অন্ততঃ দুটি কোম্পানীকে বেশ সাপোর্ট করতো কারণ সাধারণ বীমার ২(দুই) জন জেনারেল ম্যানেজার সে সময় দু’টি কোম্পানীর এম.ডি. ছিলেন। তারা জানতেন বিদেশে কাদের সাথে সাধারণ বীমা পুনঃবীমা করে, কি রেটে করে, কি সুযোগ সুবিধা পায় ইত্যাদি। সৌভাগ্যক্রমে প্রাথমিক অবস্থায় এমনই একটি কোম্পানীতে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল; যার বদৌলতে দেখতে পেরেছি ঐ সময় সাধারণ বীমার লোকজন বেসরকারী বীমা কোম্পানীর জন্য কতটা হেল্পফুল ছিল। সিনিয়ররা আমাদের নিজেদের ছোট ভাই হিসাবে গন্য করে হাতে কলমে ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে তা শোধরানের সুযোগ করে দিতেন। বর্তমান সময়ে ভুলত্রুটি ধরে নাকানি চুবানী খাওয়ানো যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
এটা ভুলে গেলে চলবে না সরকারী এবং বেসরকারী এই দুই খাত মিলে বীমা খাত। আমাদের দেখভালের জন্য আরো দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন। আমাদের আচরণ দ্বারা বীমা শিল্পের জন্য অমঙ্গলজনক কিছু হলে বীমা শিল্পই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই আমাদের সকলকেই পজেটিভ হতে হবে। একে অপরকে দোষারূপ করে আর যাই হউক বীমা শিল্পের উন্নতি হবে না।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারী জেনারেল কর্তৃক ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২৩ইং তারিখে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয়ের বরাবরে লিখিত পত্রটির একটি কপি সকল নন-লাইফ বীমা কোম্পানীর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। সে দৃষ্টিকোন থেকে আমার ২০২২ সনের সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন পোর্টালে প্রচারিত “আস্থা ফেরাতে পারে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন” লেখাটি সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
সাধারণ বীমা ও বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির কারণ মাত্র ০২ (দুই) টিঃ
১। “বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলোর ত্রৈ-মাসিক পুনঃবীমা প্রিমিয়াম প্রদান না করা”।
২। “সাধারণ বীমা কর্তৃক বেসরকারী কোম্পানীগুলোর বীমা দাবী পরিশোধ না করা”।
বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলো “ত্রৈমাসিক পুনঃবীমা প্রিমিয়াম প্রদান না করা” সাধারণ বীমার একটি অস্ত্র। এটা দিয়ে সকল কোম্পানীগুলোকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। পুনঃবীমাকারী হিসাবে তাদের দাবীর যৌক্তিকতা রয়েছে কারণ তাদেরওতো আমাদের টাকা পাওয়ার পর বিদেশে টাকা পাঠানোর ব্যাপার রয়েছে।
বিদেশী পুনঃবীমাকারীগরণ যদি তাদের ট্রিটি গ্রহণ না করেন তাহলেতো বাংলাদেশের বীমা সেক্টর এক কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়বে। তাই বেসরকারী সকল বীমা কোম্পানীর উচিৎ সাধারণ বীমার এই ডাকে যথাসাধ্য সহযোগীতা করা।
অপর দিকে বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলোর দাবী পরিশোধ না করে সাধারণ বীমা বেসরকারী কোম্পানীগুলোকে প্রায় পঙ্গু করে দিচ্ছে। দাবী পরিশোধ না করে বরং নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করার লক্ষ্যে অমীমাংসিত দাবীগুলোর বিপরীতে LPC বা Loss Participation Clause আরোপ করে কোম্পানীগুলোকে আরো দুর্বল করে চলেছে-যা নৈতিকভাবে অন্যায়।
বেসরকারী বীমা কোম্পানীগুলো বেশীদিন দাবী অনিষ্পন্ন রাখলে ব্যবসায় মন্দাভাব পরিলক্ষিত হয়। তাই তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই সাধারণ বীমার ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা পরিশোধ না করে বীমা গ্রহীতাদের দাবী পরিশোধ করতে বাধ্য হয়। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকেও দাবী পরিশোধের ব্যাপারে রয়েছে বিশেষ নির্দেশনা।
সাধারণ বীমার কাছে যদি ত্রৈ-মাসিক পুনঃবীমার প্রিমিয়াম অত্যন্ত জরুরী বিষয় হয়ে থাকে (তাদের ভাষ্যমতে তাদের পুনঃবীমাকারীদের চাহিদা) তাহলে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত সকল বেসরকারী বীমা কোম্পানীর অনিষ্পন্ন দাবীগুলো পরিশোধ করে তাদের প্রাপ্য টাকার সাথে সমন্বয় করলে কোন বেসরকারী বীমা কোম্পানীর আপত্তি করার কথা নয়।
অথবা যে সকল কোম্পানী সাধারণ বীমার নিকট প্রাপ্য তাদের টাকা সাধারণ বীমা দিয়ে দিলে আর যাদের কাছে সাধারণ বীমা প্রাপ্য তা দাবী সমন্বয়ের মাধ্যমে আদায়ের পদক্ষেপ নিলে উভয়ের মধ্যে আর কোন দূরত্ব থাকে না।
সাধারণ বীমা তাদের স্বচ্ছতার জন্য এই ব্যবস্থা নিলে বেসরকারী বীমা কোম্পানীর সাথে তাদের হিসাবের সমন্বয়হীনতার যে কথা প্রায়শঃ শোনা যায় তা থেকে মুক্ত হবার একটি মোক্ষম সময় এখন সাধারণ বীমার হাতে এসেছে যা বাস্তবায়ন করা উচিত।
সাধারণ বীমার একমাত্র আমিত্বে কোন অমরত্ব নেই। ঐক্যবদ্ধ আমরা বিরাট শক্তি, যার মাধ্যমে আমাদের বীমা শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে “আস্থা ও বিশ্বাস” অর্জনের মাধ্যমে বীমা শিল্পের ইমেজ সংকট দূর করা সম্ভব। এই ক্ষেত্রে দেশের একমাত্র পুনঃবীমা প্রতিষ্ঠান হিসাবে সাধারণ বীমাকে প্রত্যক্ষ ও পজেটিভ সহযোগীতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে অবশ্যই দেশ হবে উপকৃত এবং ধন্য হবে বীমা খাত।
লেখকঃ মীর নাজিম উদ্দিন আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোং লিঃ।