আতিকুর রহমান, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের শৈলকুপায় নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার কলেজ ছাত্র রানা ইসলামের লাশ বৃহস্পতিবার বিকালে নিজ বাড়িতে পৌছালে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণা হয়। একমাত্র ছেলের লাশ দেখে মা রেনু বেগম ও বোন সাদিয়া ইসলাম বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
শুধু রানার পরিবার নয়, গোটা গ্রাম যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। এলাকায় নম্র-ভদ্র হিসেবে পরিচিত ১৮ বছরের সুদর্শন এই যুবককে কি নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে তা তার শরীরের প্রতিটি ক্ষতচিহ্ন প্রমান করে দিচ্ছে।
বুধবার দুপুরে আওয়ামীলীগের বিবাদমান দুই গ্রুপের দ্বন্দের জের ধরে রানা ইসলামকে এক কিলোমিটার দাবড়িয়ে কুপিয়ে তার দুই পা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। তাকে প্রথমে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সন্ধ্যার দিকে অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে মারা যান।
প্রতিবেশি আকামত খাঁ জানান, রানা ইসলাম এলাকায় অত্যান্ত ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল। শৈলকুপা উপজেলার লাঙ্গলবাঁধ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে এবার স্থানীয় আদিল উদ্দীন ডিগ্রী কলেজে ভর্তির সুপারিশ প্রাপ্ত হন। কিন্তু কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেই সুদর্শন ছেলেটির জীবন কেড়ে নেওয়া হলো। তার পিতা সাইফুল ইসলাম সামাজিক দল করেন বলে সেই আক্রোশ ছেলের উপর খাটানো দুঃখজনক ঘটনা।
তিনি অভিযোগ করেন, শৈলকুপা বুপজেলা আ’লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমানের ছেলে দিনার বিশ্বাসের নেতৃত্বে ফিরোজ, সাজ্জাদ হোসেন ও আকমল মেম্বারসহ শতাধীক মানুষ এই হামলার সঙ্গে জড়িত।
রানার লাশ দেখতে আসা গোলাম মোস্তফা জানান, বুধবার আ’লীগের মতিয়ার রহমান গ্রুপের লোকজন হঠাৎ করেই গ্রামে প্রবেশ করে যাকে ইচ্ছা তাকেই মারধর ও কোপাতে থাকে। তার একদিন আগে প্রায় শতাধীক বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। রানা ইসলাম তাদের সামনে পড়ে যায়। এ সময় সে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে দৌড়ে পাশ্ববর্তী ডাউটিয়া গ্রামের প্রাচীর ঘেরা নিলুফা খাতুনের বাড়িতে ওঠে। ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার পর হামলাকারীরা জোটবদ্ধ হয়ে সেই বাড়ির তিনটি মজবুত দরজা ভেঙ্গে রানাকে বের করে নিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে দুইপা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মুমুর্ষ অবস্থায় রানাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষনা করেন।
গ্রামবাসি জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই শৈলকুপা আ’লীগ বহুধারায় বিভক্ত। শৈলকুপার সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুর পর তার গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান সভাপতি মতিয়ার রহমান ও পৌর আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকু শিকদার। প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বর্তমান এমপি নায়েব আলী জোয়ারদার, উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা আরিফ রেজা মন্নু ও পৌর মেয়র আশরাফুল আজম। নিহত রানার পিতা সাইফুল ইসলাম ছিলেন বর্তমান এমপি নায়েব আলী জোয়ারদারের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্বে থাকা মুস্তাক শিকদারের সমর্থক।
সরজমিন বৃহস্পতিবার শৈলকুপার কাশিনাথপুর গিয়ে জানা গেছে, গত সোমবার মধ্যরাতে শৈলকুপা উপজেলা আ’লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমানকে কে বা কারা পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করে। সেই ঘটনার জের ধরে মতিয়ার সমর্থকরা কুশোবাড়িয়া, বন্দেখালী ও নন্দিরগাতি গ্রামে আকিস্মিক হামলা চালিয়ে মুস্তাক শিকদারের সমর্তকদের ৫০/৬০টি বাড়ি ভাংচুর করে।
নিহত রানার মা রেনু বেগম অভিযোগ করেন, “বুধবার মতিয়ারের ছেলে শৈলকুপা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি দিনার বিশ্বাসের নেতৃত্বে আমার ছেলের উপর হামলা চালানো হয়। আমার ছেলে এ সময় নানা বাড়ি থেকে গ্রামে ফিরছিল। সে ভয়ে ডাউটি গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলেও সেই বাড়ির তিন তিনটি দরজা ভেঙ্গে বাড়ি ঢুকে তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আমার ছেলে তো কোন দল করতো না”।
ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য নায়েব আলী জোয়ারদার জানান, এতো বাচ্চা একটা ছেলেকে ওরা কিভাবে কুপিয়ে মারলো তা আমার বুঝেই আসছে না। এই হত্যা নির্মম ও নিষ্ঠুর হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি বলেন, হামলার নেতৃত্ব দেওয়া দিনার বিশ্বাস হিন্দুদের মন্দির ভাঙ্গসহ একাধিক মামলার আসামী। এই পরিবারটি শুধু বেআইনী কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে। মতিয়ারের উপর হামলা যারা করেছে একদিন তারাই তার সাাজিক দলের সঙ্গে ছিল। তারপরও আমি হামলাকারীদের গ্রেফতারের ব্যবস্থা করেছি। যতদুর পারি চেষ্টা করছি এলাকার শান্তি বজায় রাখার।
শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, রানা নামের এক কলেজ ছাত্রকে প্রতিপক্ষরা কুপিয়ে ও পিটিয়ে মারাত্মক ভাবে আহত করে। পরে তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায়।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় এখনো থানায় মামলা না হলেও হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের সনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ কাজ করছে।