আহসান আলম, চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি : আমাদের সমাজে শুধুমাত্র ছেলেরা বাইরে কাজ করবে এমন ধারণা থেকে বাইরে এসে আজ নিজেকে একটা উদাহরণ হিসাবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন চুয়াডাঙ্গার পরিশ্রমী নারী উদ্যোক্তা লিজা হোসাইন। যে মানুষগুলার কাছে কিছু দিনের জন্য অপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন আজ তাদের কাছেই তিনি প্রিয় হয়ে উঠেছেন। মেয়েরাও অনেক কিছু করতে পারে সেটা আজ তিনিও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। বর্তমানে তিনি প্রতি মাসে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রয় করছেন। লিজা হোসাইন আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ইতিমধ্যেই অর্জন করেছেন সুখ্যাতি।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরুটা কারও জন্যই সহজ হয় না। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য। তার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একদমই সহজ ছিলো না। সমাজে এমন একটা রীতি প্রচলিত আছে যে মেয়েরা পড়াশুনা শিখলে চাকরি করতে হবে। মেয়েরা কোনোভাবে বাইরে কাজ করতে পারবে না। প্রথমে বাধা আসে পরিবার থেকে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই তাকে ছোট করতে শুরু করে। একটা সময় সবকিছু থেকে দূরে গিয়ে শুধুমাত্র কাজে মনযোগ দেন। কেনো জানি অনেক বেশি মনের জোর কাজ করেছিল তার। চেয়েছিলেন সবাইকে দেখিয়ে দিতে। তবে প্রতিটা পদে পদে নানা বাধার সম্মুখীন হলেও পরবর্তীতে মা ও স্বামীর অনুপ্রেরণায় এগিয়ে চলা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত পিছনে তাকাতে হয়নি তাকে।
চুয়াডাঙ্গা শহরের মুক্তিপাড়ার বিল্লাল শেখ ও রেখা খাতুন দম্পত্তির বড় মেয়ে লিজা হোসাইন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে লিজা সবার বড়। বিবাহিত জীবনে স্বামী হোসাইন মোহাম্মদ কবীর ও তিন কণ্যা সন্তান নিয়ে লিজা হোসাইনের সুখের সংসার। মেধাবী লিজা শিক্ষা জীবন শুরু করে চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। বাবা-মা ঢাকায় থাকার কারনে তাকেও ঢাকায় চলে যেতে হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০১ সালে এসএসসি এবং ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পড়াশোনা শেষ করে কোথাও চাকরি করেননি। কারণ তিনি সব সময় চেয়েছিলেন উদ্যোক্তা হতে। পরিবারের পক্ষ থেকে বাঁধা আসলেও পরবর্তীতে মা রেখা খাতুন ও স্বামী হোসাইন মোহাম্মদ কবীরের অনুপ্রেরণায় এগিয়ে চলা। সেই থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিজার।
পড়াশোনা শেষ হবার আগে থেকেই উদ্যোক্তা হবার ভাবনা মাথায় এসেছিল। তবে নানা কারণে তখন সম্ভব হয়নি। সব সময় চেয়েছেন নিজের পরিচয় তৈরি করতে। চেয়েছেন তাকে সবাই চিনুক। সেই চিন্তা থেকেই মূলত তার উদ্যোক্তা হওয়ার ভাবনা মাথায় আসে।
নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে উদ্যোক্তা লিজা হোসাইন জানান, ‘একজন সফল উদ্যোক্তা হিসাবে আজ আমি গৌরব বোধ করি। আমি জানি এখনো আমার শেখার অনেক কিছু বাকি। প্রচ- পরিশ্রম করে আজ আমি এখানে আসতে পেরেছি। চলার পথ কখনো সহজ হয় না। আজ নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারছি। সামনে আরও উজ্জ্বল দিন দেখার অপেক্ষাতে আছি। হাজার নারীর অনুপ্রেরণা হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে চাই।
তিনি আরও বলেন, আমি একজন উদ্যোক্তা। একজন উদ্যোক্তা হওয়ার পিছনে অনকে গল্প থাকে। একজন নারীর জন্য আমাদের সমাজ, পরিবার থেকে বিভিন্ন ধরনের বাঁধা বিপত্তি আসে। একজন মেয়ের উদ্যোক্ত হয়ে সফল হওয়াটা বেশ কষ্টের। অনেক ছোট থেকেই স্বাবলম্বী নারী হিসাবে সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। ছোট কাল থেকেই হাতের কাজের উপর পারদর্শী হয়ে উঠি এবং বিভিন্ন হাতের কাজ করতে থাকি। আমার শেখা হাতের কাজগুলো আমি নিজে করতাম ও আমার এলাকার আশে পাশের গরীব, অসহায় ও স্বাবলম্বী হতে চাওয়া নারীদের শেখাতাম। আমার নিজের হাতের কাজের উপর পারদর্শী হওয়া ১৯৯৮ সালে আমার মায়ের কাছ থেকে। আমার মা আমাকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বলতেন এবং সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে আমাকে হাতের কাজ শেখাতেন না। তাও আমি আমার মায়ের সেলাই মেশিনে চুরি করে বসতাম এবং কুরুশের কাজ চুরি করে শিখতাম। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে আমি জাতীয় মহিলা সংস্থা, থেকে মেশিন এমব্রডারী কাজ শিখি। যদিও আমার বয়স হয়েছিলো না, তারপরও আমার শেখার আগ্রহ দেখে জাতীয় মহিলা সংস্থার কর্মকর্তারা আমাকে সুযোগ প্রদান করে। সেখান থেকেই আমার কাজ শুরু। ঢাকা কুড়িল থেকে কাজটা শিখেছিলাম। তারপর ২০০৭ সালে আমি ব্লক বাটিকের কাজ শিখি এবং কাজটি শুরু করি অল্প কিছু কেমিক্যাল কিনে। একটা পুরাতন শাড়িতে ব্লক বাটিকের কাজ করলে আশে পাশের মানুষ আমার কাজটা দেখে অর্ডার দেন। সেই থেকে খুব উৎসাহের সাথে শুরু করে দেই। ভালো একটা আয় শুরু হয়। তারপর মাথায় আসে বিউটিফিকেশন নিয়ে। বাসা থেকে অনেক দূরে এক পার্লারে যেয়ে কাজ শিখি।
ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে লিজা হোসাইন বলেন, আমি বিবাহিতা এবং আমার তিন মেয়ে আছে। যখন ব্লক বাটিক আর পার্লারে কাজ শিখি আমার ২য় কন্যার বয়স ১ বছর। আমার ২য় কন্যাকে বাসায় রেখে আমি কাজ শিখতে যেতাম। সংসারে উন্নতি এবং মানুষের জন্য কিছু করাই আমার কাজ শেখার উদ্দ্যেশ্য ছিল। এইভাবে আমি অর্ডার নিয়ে বাড়িতে কাজ করতাম। সব সময় মানুষের পরিস্থতি এক থাকে না। আমি ২০১৪ সালে ঢাকা থেকে চুয়াডাঙ্গায় চলে আসি। তারপর থেকে জীবনের চলার পথ একটু আলাদা করে ফেলি। আমি কিছু অসহায় নারীদেরকে হাতে সেলাইয়ের কাজ দিতাম। কাঁথা সেলাই দিতাম ওরা সারাদিন রাত কাজ করে মুজুরটা অল্প হতো। তাদের সংসারের অভাব মেটাতে পারতো না। তাদের অসহায়ভাবে চলাচল দেখে আমি প্যাকেটের ব্যবসা শুরু করি। এর মাঝে আমি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে প্যাকেট বানানো দেখি এবং সেটা থেকেই আমার আগ্রহ আছে। প্যাকেট বানানো শিখলে মেয়েরা বেশি টাকা আয় করতে পারবে। আমার জমানো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করি কার্টুনের ব্যবসা। মিষ্টির বক্স, কেক, পিজ্জা বক্স ইত্যাদি আল্লাহর রহমতে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এখন আমার ব্যবসা ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকার মেশিন আর কাঁচামাল আছে। দোকানে ৪ জন বেতনভুক্ত কর্মচারী দুইটা ভ্যান এবং ১৫০ জনের বেশি বক্স বানানো কর্মচারী আছে। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে এতগুলো মানুষের ঘরে বসে আয় করার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে, ইচ্ছা আছে এটাকে আরো বাড়ানোর। আমার স্বেচ্ছাসেবি হিসাবে এই কাজগুলো করা দেখে ২০১৭ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর আমাকে একটি সংস্থার অনুমোদন দেয়। আমি আমার কোন কাজ বন্ধ করিনি। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গায় একটি পার্লার আছে, সেখানে তিনজন নারী কাজ করছে। আমার বুটিকসের কাজ করে ৩০ জন নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আমি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের সেলস্ ও ডিসপ্লে সেন্টারের ইনচার্জ হিসাবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছি। আমি ২০১৫ সাল থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বিশেষ ট্রেইনার হিসেবে কাজ করছি। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর জেলার বিশেষ ট্রেনিং আমাকে দিয়েই করিয়ে থাকে। ব্লক বাটিক, বিউটিফিকেশন ইত্যাদি ট্রেনিং দিয়ে থাকি। চুয়াডাঙ্গা যুব উন্নয়ন থেকে ২০২৩ সালে যুব দিবসে সফল আত্মকর্মসংস্থান সম্মাননা পাই। সদর উপজেলা থেকে শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষক হিসাবে সম্মাননা পাই ২০২২ সালে। আমি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে উপজেলা এবং জেলা থেকে জয়ীতা হয়েছি ২০২২ সালে এবং বিভাগীয় ভাবে জয়ীতা হয়েছি ২০২৩ সালে।
এছাড়াও যুব মতবিনিময় ২০২৪ শেখ হাসিনা যুব ইন্সটিউটে চুয়াডাঙ্গার প্রতিনিধি হিসাবে অংশগ্রহণ করি। আইন শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য হিসেবে মাদক, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধ ইত্যাদি কাজ করে যাচ্ছি। সমাজের সেবামূলক বিভিন্ন সংস্থার সাথে সংযুক্ত আছি। পরিবার থেকে সব সময় সহযোগিতা ও উৎসাহ পেয়ে আসছি। আমার বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেজো মেয়ে চুয়াডাঙ্গা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত এবং ছোট মেয়ে অসুস্থ। সবকিছু সামলানো বেশ কষ্টকর। আমার ছোট মেয়ের চিকিৎসা চলমান আছে। তারপরেও মানুষের জন্য কাজ করতে আমার ভালো লাগে। আমার জন্য সবাই দো’আ করবেন।