মাহমুদুল ইসলাম : ইসলাম মানবজীবনের সব দিক নিয়ে আলোকপাত করে, আর্থিক অর্থব্যবস্থা পরিচালনা কোনো ব্যতিক্রমী চিন্তার বিষয় নয়। সুদমুক্ত আর্থিক পরিষেবা শিল্পের সঙ্গে ইসলামি আর্থিকব্যবস্থা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ ‘ইসলামী ফিন্যান্স শিল্প’ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চমৎকার অভিজ্ঞতা এবং অগ্রগতি সাধন করেছে। ৩১ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী ফিন্যান্স বা ইসলামী ব্যাংকিং ও ফিন্যানশিয়াল খাত ১৩১টি দেশের তালিকায় ১৭তম অবস্থানে রয়েছে।
ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে যেমনিভাবে আল্লাহর বিধান মেনে চলা আবশ্যক, অনুরূপভাবে অর্থ উপার্জন ও ব্যয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান মেনে চলা আবশ্যক। অর্থনৈতিক জীবনে যাতে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন না হয় এর জন্য হালাল-হারামের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নীতি-পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের যাবতীয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাই ইসলামি অর্থনীতি। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ এম নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন- “ইসলামি অর্থনীতি সমকালীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাব”। ডঃ এম এ মান্নান বলেন- “ইসলামি অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে”। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার অঙ্গসংগঠন আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকহ একাডেমি ১৯৮৫ সালে তাদের দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রচলিত বাণিজ্যিক বীমা সমূহকে হারাম বা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে এবং সেই সাথে তাকাফুলকে সহযোগিতা, ঝুঁকি ভাগাভাগি এবং পারস্পরিক সহায়তার লক্ষ্যে শরীয়াহ সম্মত পদ্ধতি হিসাবে অনুমোদন দেয়।
সুদের বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বেশ কয়েক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না। আল্লাহকে ভয় করো। তাহলে তোমরা সফল হতে পারবে। ’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত- ১৩০)। সূরা আল-বাকারাহ’র হ’র ২৭৮ ও ২৭৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “হে বিশ্বাসীরা, আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদ বাবদ মানুষের কাছে যা তোমাদের পাওনা আছে তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। ( সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত- ২৭৮)। “আর যদি তা না কর, তবে ধরে নেয়া হবে যে, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছ। যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তোমাদের জন্যই তোমাদের মূলধন রয়েছে। তোমরা সুদ নিয়ে অত্যাচার করো না এবং মূলধন হারিয়ে অত্যাচারিতও হয়ো না।” (সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত- ২৭৯)। নবী (স.) মুসলমানদের সমাবেশে সুদ সংক্রান্ত সকল চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন। রাসুল (স.) সবার আগে সুদের লেন দেন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য নিজের আত্মীয় স্বজনের প্রতি আহবান জানান।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যা মানুষকে ইহকাল এবং পরকালের সফলতার দিকে পরিচালিত করে। ইসলাম মানুষকে পারস্পারিক সহযোগীতার লক্ষ্যে অংশীদারিত্ব ও সহমর্মীতার কথা বলে। পারস্পারিক সহযোগীতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত হয় ইসলামী জীবন ব্যবস্থা। প্রচলিত বীমায় শরিয়াহবিরোধী উপাদান রয়েছে, অন্যদিকে তাকাফুল বা ইসলামি জীবন বীমা পলিসিতে তা অনুপস্থিত। যেমন: ক. আল্-ঘারার (অজানা/অনিশ্চয়তা), খ. আল্-মাইসির (জুয়া) ও গ. আলরিবা (সুদ)। আমাদের সুদ থেকে বিরত থাকতে হবে আবার সঞ্চয়মুখিও হতে হবে। সে কোরণে ইসলামী বীমা হতে পারে সঞ্চয়ের উত্তম মাধ্যম। রাসূলে করীম (স) বলেছেন-“তোমাদের উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব, পরমুখাপেক্ষী ও অপর লোকদের উপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়া অপেক্ষা তাদেরকে সচ্ছল, ধনী ও সম্পদশালী রেখে যাওয়াই উত্তম।” (সহীহ আল্-বুখারী)
তাকাফুল হচ্ছে ইসলামী শরীয়াহ সম্মত সমবায়ভিত্তিক এক ধরণের ঝুঁকি বণ্টন পদ্ধতি বা প্রচেষ্টা, যেখানে একজনের প্রয়োজনে অন্যজন শরীক হয় অর্থাৎ সদস্যগণ কিংবা অংশগ্রহণকারীগণ দলবদ্ধভাবে এ কথায় সম্মত হন যে, তাদের নিজেদের যে কোন নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ সমস্যা বা সম্ভব্য দুর্ঘটনায় লোকসান বা ক্ষতির বিপরীতে বিপদ লাঘবের জন্য তারা সবাই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা করবে এবং যদি কারো ক্ষতি হয় তবে উক্ত জমা থেকে তার ক্ষতিপূরণ করা হবে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তাকাফুল বা ইসলামী বীমা প্রচলিত বীমা ব্যবস্থার বিপরীত হিসেবে বিবেচিত হয়। তাকাফুল মূলত পারস্পরিক সুরক্ষার জন্য একে অপরের সম্ভব্য ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা সরূপ।
মুসলমান পণ্ডিতগণ একটি ইসলামী শরীয়াহ সম্মত কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থপনা পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা ও পর্যালোচনা করেন আসছিলেন। এজন্য পণ্ডিতগণ গবেষণা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্মেলনগুলো হচ্ছে: ১৯৬১ সালে দামেস্ক সম্মেলন, ১৯৬৫ সালে কায়রো সম্মেলন, ১৯৭৫ সালে মরোক্কো ও লিবিয়া সম্মেলন এবং ১৯৭৬ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন। সর্বশেষ, ১৯৮০ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে ইসলামী বীমা চালু করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। উক্ত সম্মেলনে ওআইসিভুক্ত সদস্য দেশসমূহ সর্বসম্মতভাবে ইসলামী বীমা চালুর পক্ষে মত দেন। প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৭৯ সালে সুদান ইসলামী বীমার কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে, ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অন্যান্য মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমুহ যেমন: দুবাই, সৌদি আরব, বাহরাইন এবং জর্ডানে ইসলামী বীমা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটে। উক্ত প্রচলিত ইসলামী বীমা ব্যবস্থা তাকাফুল নামেই অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। মালয়েশিয়ায় ১৯৮৩ সালে ‘তাকাফুল (বীমা) অ্যাক্ট ১৯৮৪’ পাস হয়। এরপর ওই বছর ২৯ নভেম্বর প্রথম প্রতিষ্ঠা হয় ‘শারিকাতুততাকাফুল সেন্ডিরিয়ান বারহাদ লি.’। পাকিস্তানে ২০০৫ সালে তাকাফুল রুলস জারি হয়। এরপর সেখানে তাকাফুলকোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়।
এ দেশে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় যুগ পরও স্বতন্ত্র ‘ইসলামী বীমা আইন’তৈরি হয়নি। অথচ বাংলাদেশের পরে কিছু দেশে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং সেখানে তাকাফুলবিষয়ক স্বতন্ত্র আইন রয়েছে। সাধারণত যেটা দেখা যায়, প্রথমে স্বতন্ত্র ইসলামী বীমা আইন তৈরি হয়, এরপর ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠা হয়। যেমন মালয়েশিয়ায় ১৯৮৩ সালে ‘তাকাফুল (বীমা) অ্যাক্ট ১৯৮৪’ পাস হয়। এরপর ওই বছর ২৯ নভেম্বর প্রথম প্রতিষ্ঠা হয় ‘শারিকাতুত তাকাফুল সেন্ডিরিয়ান বারহাদ লি.’। পাকিস্তানে ২০০৫ সালে তাকাফুল রুলস জারি হয়। এরপর সেখানে তাকাফুল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়। এটি শুধু বাংলাদেশের ইসলামী বীমার চিত্র নয়; এ দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের চিত্রও অভিন্ন। সব চলে সুদি ও জেনারেল আইনের আওতায়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এটি খুবই দুঃখজনক।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিপূর্ণ ইসলামী বীমা আইন সম্ভব না হলেও প্রচলিত বীমা আইনের সংশোধনের মাধ্যমে এ দেশে ইসলামী বীমা সম্প্রসারণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০ এর কিছু ধারায় সংশোধনী আনা খুবই প্রয়োজন। সেগুলো হলো- ধারা নং ৭ (বিসত্মারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন), ধারা নং ১৬.৬ ( সুদমুক্ত ইসলামী বীমার মান অনুসারে সম্ভাব্য মুনাফার পরিমাণ নির্ধারণ করা যেতে পারে), ধারা নং ৫৮.৩ (শরিয়তসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ), ধারা নং ৭৪ (সবার সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ), ধারা নং ৮৩ (লাভ-ক্ষতি সমহারে বণ্টনযোগ্য), তফসিল ১ ধারা নং ১,২,৩,৪,৫,৬ (শরিয়তসম্মত পরিমাণ নির্ধারণ)। বর্তমান বিশ্বে ইসলামী বীমার ক্রম সম্প্রসারণ ঘটেছে। তারই সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও ইসলামী বীমার অগ্রগতি ঘটেছে। এখন দলমত নির্বিশেষে বীমা ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। বাংলাদেশের প্রায় ১৬ কোটি মুসলমানের হৃদয় জয় করেই সম্ভব ইসলামী বীমার সম্প্রসারণ।
বাংলাদেশে পূর্ণ ও উইন্ডোসহ লাইফ এবং নন-লাইফ মোট বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৮১ । তার মধ্যে ইসলামী বীমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৪টি। ৩ টি নন-লাইফ পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বীমা কোম্পানি, ১১ টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন বীমা কোম্পানি। এছাড়াও বেশ কিছু লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইসলামী বীমা উইং এ ইসলামী বীমা ব্যবসা পরিচালনা করছে। দিন দিন সংখ্যার বিচারে ইসলামী বীমা শিল্প বাংলাদেশে বেশ অগ্রসর। অল্প সময়ে ইসলামী বীমা বা তাকাফুলের এই অগ্রযাত্রা উৎসাহব্যঞ্জক।
১৯৯৯ সালে সরকার ইসলামী নামকরণ এবং মেমোরেন্ডাম অব আর্টিকেলসে শরিয়া কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে দেশে ইসলামী জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০০০ সালে জীবন বীমায় ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড কার্যক্রম শুরম্ন করে। অপরদিকে সাধারণ বীমায় ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড, তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড তাদের কার্যক্রম শুরম্ন করে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৬ মে ইসলামী জীবন বীমা কোম্পানি হিসেবে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হতে অনুমোদন লাভ করে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ইসলামী অর্থনৈতিক নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসেবে ইসলামী বীমার প্রসার এবং এর প্রভূত কল্যাণ নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। ইসলামী বীমার বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমরা দেশকে সমন্বিত উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তৈরি করতে পারব। ইনশাআল্লাহ।
লেখক: মোঃ মাহমুদুল ইসলাম, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা বিভাগীয় প্রধান এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। ও ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (বিআইডিএস)